সত্য জেনেও অস্বীকার করাটা চরম দুঃখজনক Tragedy Knew the Truth & made a choice to reject


মার্ক ১০:১৭-২৭ (লূক ১৮:১৮-৩০; মথি ১৯:১৬-২৬)

জীবনের জন্য সত্য জেনেও তা অস্বীকার করাটা হয় চরম দুঃখজনক। একটি যুবক যীশুর কাছে এসেও পরিত্রাণবিহীন অবস্থায় ফিরে গেলেন। ঘটনাটি মার্ক লিখিত সুসমাচার বাদেও মথি ও লূক লিখিত সুসমাচারে আছে। এই তিনটি সুসমাচার এনাকে একজন ‘ধনী’ লোক বলে ইঙ্গিত দেয়। মথিতে বলা আছে ব্যক্তিটি যুবক; লূকে বলা আছে ইনি অধ্যক্ষ (সমাজনেতা)। ইনি ধর্মশিক্ষায় পারদর্শী, স্থানীয় ধর্মশালার একজন যুব অধ্যক্ষ/নেতা ছিলেন।
    
ঘটনাটি যেখানে ঘটে সেখানেই এই যুবকের পরিত্রাণ পাওয়া উচিত ছিল; তার পাপের ক্ষমার কথা ছিল; অনন্ত জীবন পাওয়ার একটি চমৎকার অবস্থা ছিল, সুযোগ ছিল ঈশ্বরের সন্তান হওয়ার। তবুও তিনি ঈশ্বরের পুত্রকে কাছে পেয়েও, অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় খ্রীষ্টকে ত্যাগ করে চলে গেলেন। কারণ তিনি সত্য জানলেন কিন্তু মেনে নিতে চাইলেন না। সত্য কথা ছিল - অসত্য ও অসারতা থেকে মন ফিরিয়ে সত্যকে অনুসরণ করা - স্বর্গে যেতে সত্য কথার বাধ্য থাকা।

মার্ক ১০:১৭ পদে এই ধনী যুবকটির একান্ত ইচ্ছার কথা আমরা জানতে পারি যে - “অনন্ত জীবনের অধিকারী হইবার জন্য আমি কি করিব?” চিন্তা করলে মনে হয় যে তিনি পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য একেবারে উপযুক্ত প্রার্থী। ১৭ পদ লক্ষ্য করুন : “. . . একজন দৌড়াইয়া আসিয়া তাঁহার সম্মুখে জানু পাতিয়া জিজ্ঞাসা করিল . . .” এ অবস্থায় তার মধ্যে একটি আবেগ লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে একটি জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। যুবকটি শিক্ষিত, আদর্শবান, নীতিবান লোক, আর অনন্ত জীবনের জন্য আগ্রহী ছিলেন, যদিও আত্মিকতার কোনো ছোঁয়া তার জীবনে ছিল না। তিনি যীশুর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বিনীত ও ভক্তিশ্রদ্ধায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্বা জানালেন, যীশুকে অভিবাদন জানালেন “সৎ (মঙ্গলময়) গুরু” বলে।   

১৮-২০ পদগুলি পাঠ করে বোঝা যায় যে তিনি ব্যবস্থা পালনকারী। ছোটবেলা থেকেই মোশীর আইন-কানুন পালন করেন। ঈশ্বর ও তাঁর বাক্যের মনোযোগী। তিনি নিজেকে ঈশ্বর ও মানুষের একজন দায়িত্ববান ব্যক্তিরূপে দেখান। তিনি ব্যবস্থা-রক্ষক। তিনি সমাজগৃহের অধ্যক্ষ বা নেতা।

তিনি পরিত্রাণের জন্য সঠিক প্রার্থী ছিলেন। যুবকটির জীবনে সবকিছুতে সুন্দরভাবে পালন করতে দেখা যায়। সাধারণত যুবক/যুবতীদের এসব করা পছন্দ নয়, ধর্ম পালনে আগ্রহী নয়। যাহোক তিনি জীবনে বেঁচে থাকতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর জন্য ছিলেন না। তার জীবনে জাগতিক সাফল্য বা উন্নতি থাকা সত্বেও আত্মিকতার তার অভাব ছিল। আত্মিক বাস্তবতা তার জীবনে ছিল না, যদিও তার ধর্ম ছিল আর ধর্মকর্মে থাকতেন। তিনি তার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একজন নেতা ছিলেন। টাকা-পয়সায় পরিত্রাণের সমাধান হয় না। জীবনে বেঁচে থাকতে আপনার আমার মতো অন্য কোনো সমস্যা তার ছিল না, কিন্তু সমস্যা ছিল তার ‘মরণে’। তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চেয়েছেন, অনন্ত জীবনের একটি উপায় তিনি চেয়েছেন। আজ অনেকেই এই জীবনের চিন্তা-ভাবনায় একটা সমাধান খুঁজে বের করেন। কিন্তু অনন্ত জীবনের জন্য নয় - আত্মিক জীবনের জন্য নয়। এই যুবকটি অনন্ত জীবনের তালাসে তিনি সঠিক ব্যক্তির খোঁজ পান, আর দেরি না করে ভিড় ঠেলে চটাপট দৌঁড়ে আগেভাগে অনন্তের বিষয়ে, অনন্ত জীবনের ভাগ নেওয়ার চিন্তায় একেবারে উপযুক্ত সৎ/মঙ্গলময় গুরুর কাছে উপস্থিত হন। আর ভক্তি-শ্রদ্ধায় তাঁর কাছে হাঁটু গাড়লেন। তিনি সঠিক উদ্দেশ্যেই এসেছেন। অনন্ত জীবনের জন্য তার খুব আগ্রহ ছিল, এ বিষয়ে তার সঠিক বিবেচনাও ছিল। তিনি তার জীবনে ছ্যাবলামির লোক ছিলেন না। এমন কি পরবর্তী জীবনকে নিয়েও ধানাইপানাই তামশা করতে চান নাই। তিনি ঠিক সময়ই এসেছিলেন আর যীশু তার একদম কাছেই। তিনি শাস্ত্র জানেন “সদাপ্রভুকে অন্বেষণ কর, যাবৎ তাঁহাকে পাওয়া যায়, তাঁহাকে ডাক, যাবৎ তিনি নিকটে থাকেন।” যিশাইয় ৫৫:৫,৬ পদ।

প্রিয় পাঠক আমরাও জানি যে যীশু বলেছেন - “যে আমার কাছে আসিবে, তাহাকে আমি কোনো মতে বাহিরে ফেলিয়া দিব না।”  যোহন ৬:৩৭ পদ।

এমনতো না যে যীশুর জন্য একজন খাঁটি বিশ্বাসীর সবকিছুই ত্যাগ করতেই হবে। যুবকটির এ বিষয়ে মূর্খতা ছিল (১৮-২১ পদ)। অনেকেই বিশ্বাসযোগ্য বিষয় বিশ্বাস করেন বটে, কিন্তু ঈশ্বরের দৃষ্টিকোনে তারা পরিত্রাণপ্রাপ্ত নন্। মূর্খতা, বোকামী, অন্ধকারে থাকা মানুষের পাপাচার ও তার নৈতিকতার পতন ও লম্পটতার কথা বলে। অবিশ্বস্ততা, শয়তানি নৈতিক অবনতির একটি চিহ্ন।

ওয়েবস্টার বলেছেন যে অনেকেই তাদের নৈতিক বিচ্যুতির দিকে যেমন কুপথ, অপকর্ম, বিকৃত চিন্তা, অনাচার, অবক্ষয়, গাফিলতি, নিয়ম ভঙ্গ ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য দেয় না। আমরা এইসব ঢাকবার জন্য ক্ষমতাশালী, হুকুমদারী বা জবরদস্তি কর্ম করি। কিন্তু আমরা নিচে, একেবারে গভীরের দুর্বলতার বিষয়ে কোনো দ্বিধা, সংশয়/সন্দেহ করি না বা বিশ্বাস করতে চাই না যে সেখানে কোনো ব্যাধি রয়েছে যা আমাদেরকে কুড়ে কুড়ে খায়, আর আমাদের চিন্তা-চেতনা, আমাদের কথা (জ্ঞান), আমাদের সম্পর্ক, আমাদের মানসিক চাঞ্চল্য বা আবেগ, অনুভূতিকে নোংরা করে। আমাদের কর্ম, ইচ্ছা, আগ্রহকে একেবারে নষ্ট করে।   

“মনুষ্য হইতে যাহা বাহির হয়, তাহাই মনুষ্যকে অশুচি করে। কেননা ভিতর হইতে, মনুষ্যদের অন্তঃকরণ হইতে, কুচিন্তা বাহির হয় - বেশ্যাগমন, চৌয্য, নরহত্যা, ব্যভিচার, লোভ, দুষ্টতা, ছল, লম্পটতা, কুদৃষ্টি, নিন্দা, অভিমান ও মূর্খতা, এই সকল মন্দ বিষয় ভিতর হইতে বাহির হয়, এবং মনুষ্যকে অশুচি করে।” মার্ক ৭:২০-২৩ পদ।

লক্ষ্য করুন যে আমাদের প্রভু সমস্ত মানবজাতির হৃদয়/মনকে এক কথায় “অন্তঃকরণ”-কে উল্লেখ করেছেন। মানুষের স্বভাব, বৈশিষ্ট্য জন্মগতভাবে মন্দ, অশুচি - ২১ পদ। মানুষের মন বা অন্তর থেকে “কুচিন্তা বাহির হয়”। মানুষের ভিত্তিই হলো পাপেপূর্ণ ও দুষ্টতায়। মথি ৭:১১ যীশু বলেন - “অতএব তোমরা মন্দ হইয়াও . . . ” অনেকে এ নিয়ে অনেক তর্ক করতে পারেন। আপনার চিন্তা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা, ও পরিকল্পনার কথা চিন্তা করুন, যা কেউ কখনো আগ-বাড়িয়ে জানার চেষ্টা করবে না, কিন্তু ঈশ্বর ঠিকই জানেন। রোমীয় ৭:১৮ পদে পৌল বলেছেন যে - মানুষের মধ্যে “উত্তম কিছুই বাস করে না”। যিশাইয় ৮:২১ পদে আমাদের বলে যে - মানুষের “কোনো স্থানে স্বাস্থ্য নেই” অর্থাৎ সুস্থতার কোনো স্থান নেই। রোমীয় ৮:২১ পদে আমাদের বলে যে মানুষ হলো “ক্ষয়ের দাসত্ব”। ২পিতর ২:১৯ পদ আমাদের বলে যে - মানুষ হলো “ক্ষয়ের দাস”।

১৭ ও ১৮ পদ লক্ষ্য করে দেখুন - যীশু সার্বভৌম অসীম ক্ষমতা ও উৎকৃষ্টতার অধিকারী আর তিনি পাপ সম্পর্কে এই অন্বেষণকারীর মুখোমুখি হয়েছেন। যীশু তিনি কে, এই বিষয়ে আমাদের প্রভু এই লোকটির অনুভুতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধনী যুবক নেতার পাপেপূর্ণ অবস্থার উপলব্ধি, মনের ভাব ও বোধ পরীক্ষা করলেন। যুবক নেতা মনে করেছেন যীশু একজন বড় শিক্ষক/গুরু। কিন্তু তিনি চিন্তা করেন নাই যে যীশু হলেন একেবারে ঈশ্বরের পুত্র বা ঈশ্বরপুত্র। তিনি বুঝতে পারেন নাই যে তিনি হলেন ঈশ্বর-মানব। যীশু বলেন “আমিই পথ ও সত্য ও জীবন; আমা দিয়া না আসিলে কেহ পিতার নিকটে আইসে না।” যোহন ১৪:৬ পদ। 
  
“তোমরা তোমাদের পাপসমূহে মরিবে; কেননা যদি বিশ্বাস না কর যে, আমিই তিনি, তবে তোমাদের পাপসমূহে মরিবে।” যোহন ৮:২৪ পদ।

যদি কেউ বুঝতে না পারে যে যীশু তিনি কে, তাহলে তিনি এখনো পরিবর্তীত হন নাই। “যীশু তাহাকে কহিলেন, আমাকে সৎ কেন বলিতেছ? একজন ব্যতিরেকে সৎ আর কেহ নাই, তিনি ঈশ্বর। তুমি আজ্ঞা সকল জান, “নরহত্যা করিও না, ব্যভিচার করিও না, চুরি করিও না, মিথ্যা-সাক্ষ্য দিও না, প্রবঞ্চনা করিও না, তোমার পিতামাতাকে সমাদর করিও”। সেই ব্যক্তি তাঁহাকে কহিল, হে গুরু, বাল্যকাল অবধি এই সকল পালন করিয়া আসিতেছি।” মার্ক ১০:১৯-২০ পদ।

অনেকেই নিজেদের পাপাচার, অন্যায়, অনাচারের বিষয়ে বুঝতেই চান না যে তারা নিজেরাই এই বিষয়ে নির্বোধ। এনারা নিজেদেরকে সাধু মনে করেন ধর্মের বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানে ও বাইরের চেহারার আলোকে, এবং উপর-উপর/ভাষা-ভাষা বাহ্যদৃষ্টির বিচারে নিজেদেরকে সেভাবে দেখেন। এনারা নিজেদেরকে এমনভাবে তুলে ধরেন যে “আমি আমার স্ত্রীকে বা স্বামীকে ঠকাই না,” “আমি কাউকে মারি না”, “আমি চুরি করি না”, “আমি মিথ্যা বলি না”, “আমি কারোর উপর নিজের স্বার্থের চিন্তা করি না,” “আমি আমার বাবা মাকে সম্মান করি,” ইত্যাদি, ইত্যাদি। 
  
রোমীয় ৮:৭ পদে রয়েছে, “কেননা মাংসের ভাব (মানুষের পাপ-স্বভাব) ঈশ্বরের প্রতি শত্রুতা (ঈশ্বর-বিরোধী), কারণ তাহা ঈশ্বরের ব্যবস্থার বশীভূত হয় না,” এই শত্রুতা - ঈশ্বর-বিরোধী, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বৈরিতাস্বরূপ (ঈশ্বরকে ঘৃণার মনোভাব, তাঁকে মনের বিষ মনে করা) যা-কিনা কোনো শর্তেই, কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না বা গ্রহণ করা যায় না, আর এর কোনো মীমাংসাও হয় না। শত্রু মিটমাট/মীমাংসা হতে পারে কিন্তু ঘৃণার মনোভাব (শত্রুতা) নয়।
 
রোমীয় ৫:১০ পদ “কেননা যখন আমরা শত্রু ছিলাম, তখন যদি ঈশ্বরের সহিত তাঁহার পুত্রের মৃত্যু দ্বারা সম্মিলিত হইলাম।” - যীশুর প্রায়চিত্ত হলো সেই ভিত্তি যাতে শত্রুদের মীমাংসা হতে পারে। যীশুর মৃত্যুতেই ঈশ্বরের প্রতি মানুষের এই শত্রুতাকে ধ্বংস করতে হয়েছে। 

ইফিষীয় ২:১৫ পদ “শত্রুতাকে, বিধিবদ্ধ আজ্ঞাকলাপরূপে ব্যবস্থাকে, নিজ মাংসে লুপ্ত করিয়াছেন . . .” অর্থাৎ যীশু খ্র্রীষ্ট তাঁর ক্রুশে দেওয়া দেহের মধ্যে দিয়ে সমস্ত আদেশ ও নিয়ম সুদ্ধ মোশির আইন-কানুনের শক্তিকে বাতিল করেছেন। এইভাবে যে শত্রুতার ভাব এই দুইয়ের মধ্যে দেওয়ালের মত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তা তিনি ভেঙে ফেলেছেন।

এই শত্রুতা বা দুশমনি - শত্রুর চেয়েও বেশি, যা-কিনা কু-ইচ্ছা প্রকাশ করা, কু-মতলব করা, ঘৃণা করা, কুচোখে দেখা, অমঙ্গলকামনা করা, অভিশাপ দেওয়া, জ্বালাতন করা। বিষয়টি অরুচি, অপ্রিয়, অনীহা, বিরক্তির থেকেও বেশি প্রকাশ পায়। এই শত্রুতা অটল থাকে আর একের পর এক বারবার ভিন্নভাবে ঘৃণার জন্ম হয়। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এই শত্রুতা ঠিক যেন প্রভুকে বিরোধিতা করা নয়, কিন্তু একেবারে নিজের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করা, নিজেই বিরোধে জড়িয়ে পরা।

- প্রভু যীশু খ্রীষ্ট অন্ধ নন্, কিন্তু উনি নিজেই অন্ধ।
- প্রভু যীশু খ্রীষ্ট বিকৃত/কলুষিত নন্, কিন্তু উনি নিজেই বিকৃত/কলুষিত।
- প্রভু যীশু খ্রীষ্ট বিরোধী নন্, কিন্তু উনি নিজেই বিরোধী/বিদ্রোহী আর অবাধ্য।
- প্রভু যীশু খ্রীষ্ট শত্রু নন্, কিন্তু তিনি নিজেই শত্রু, তার মধ্যে রয়েছে শত্রুতা।

গীতরচক গীত ৫:৯ পদে বলেছেন “তাহাদের অন্তর দুষ্টতাময়।” - মানুষেরা কীভাবে মিথ্যা বলায় ন্যায়পরায়ণ হতে পারে? মানুষেরা কিভাবে অশ্লীলতায় দৃষ্টি দেয় আর নিজেকে সৎ-নীতিবান লোক হিসাবে প্রকাশ করতে পারে। ঈশ্বরের কোনো ভয় না থাকায় মানুষ কিভাবে এতে ভণ্ড হতে পারে। মানুষেরা কেন অন্যদের মতন খারাপ কথা বলে আর নিজেদের একটুও দোষ দেয় না। মানুষেরা কেন কোনো কষ্ট ও দুঃখ না পেয়ে অন্যদের প্রতি খারাপ আচরণ করে। মানুষেরা যখন ভুল করে তখন নিজের সত্যতা স্বীকার না করে মানবীয় আচরণে কেন এত গর্ব, এত দাম্ভিকতা।

মানুষেরা ভণ্ড হয়ে মানুষদের গালাগালি দেয়, আর ধর্মকর্মের মুখে তারা ঈশ্বরের কথা বলে। মানুষ অন্যের বিচার করে, কিন্তু তার নিজের এতটুকুও বিচার করে না। সে ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘন করে (মানে না) কিন্তু অন্যেরা যখন তার মতো সেরকম করে, তার দোষ ধরে।

আমাদের প্রত্যেকেরই স্বভাবগতভাবে ঈশ্বরে বিরোধিতার বৈশিষ্ট্য/আচরণ রয়েছে। কারোর জীবন পাপে না থাকার কারণে এই অর্থ হয় নয় যে তার পাপেপূর্ণ স্বভাব/বৈশিষ্ট্য থাকে না। বিষধর সাপ ফুলশয্যায় শুয়ে থাকলেও বিষ থাকেই। সিংহকে দেখতে নিষ্পাপ, নিরাপরাধ, শান্ত লাগলেও সে ঠিকই হত্যাকারী হয়। কোনো শান্ত সমুদ্র কোনো প্রচ- ঝড়ের মধ্যে প্রাণ ধ্বংসের অবস্থা ঘটাতে পারে।

সাধু পৌল রোমীয় ৭ অধ্যায়ে মানুষের পাপ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন : “দুর্ভাগা মনুষ্য আমি।” - তাই মানুষ ঈশ্বরের প্রতি শত্রুতা (ঈশ্বর-বিরোধী)। মানুষের একমাত্র আশা হলো ঈশ্বরের দয়া, ঈশ্বরের অনুগ্রহ, আর অনন্ত জীবনের দান গ্রহণ করা। মানুষ কখনো নিজেরা নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে না। মানুষ ঈশ্বরের দয়া ও অনুগ্রহ চাইতে পারে কিন্তু এইভাবে তাঁকে পরিত্যাগ করায়, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করায়, নিজের ইচ্ছায় থাকায়, পাপে থাকায় মুক্তিদাতার সেবা করার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে না।
      
“কারণ তাহারা নিজেরা আমাদের বিষয়ে এই বার্তা প্রচার করিয়া থাকে যে, তোমাদের নিকটে আমারা কিরূপে উপস্থিত হইয়াছিলাম, আর তোমরা কিরূপে প্রতিমাগণ হইতে ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়া আসিয়াছ, যেন জীবন্ত সত্য ঈশ্বরের সেবা করিতে পার।” ১থিষলনীকীয় ১:৯ পদ।

মনপরিবর্তন হলো মনের, হৃদয়ের, অন্তঃকরণের, অনুভুতির, চিন্তার, মনোভাবের পরিবর্তন - আমি যেমন ও যা, তার জন্য আমি দুঃখিত আর আমি যা করেছি তার জন্য আমি দুঃখিত।”

মার্ক ১০:২০ পদে এই যুবক নেতার “হে গুরু, বাল্যকাল অবধি এই সকল পালন করিয়া আসিতেছি” - এই কথায় নিজের সততা সম্পর্কে সাফাই গাওয়া বা নিজেকে সমর্থন করা। নিজেকে এভাবে সাধু মনে করায় তার মূর্খতা, জাগতীকতা, মাংসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। ২১ পদে আমাদের প্রভু তাকে “এক বিষয়ে তোমার ক্রটি আছে” বলায় লোকটিকে মন পরিবর্তনের আহ্বান করেন আর এই কথাতেই ছিল প্রভুর প্রতিকার। একজনের পাপ থেকে ঈশ্বরের দিকে ফিরে আসা। এই ধনী যুবকের ধনসম্পদ থাকাটা কোনো পাপ ছিল না, কিন্তু পাপ ছিল অর্থ প্রেম ও লোভ-লালসা। কোনো একজন বলেছেন যে : “এর পরিক্ষা বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন প্রকারের। অনেকের জন্য জাগতীক শ্রদ্ধা, সম্মান, সুনাম, মর্যাদা ও আশা-ভরসা ত্যাগ করা কষ্টকর ও কঠিন, আর খ্রীষ্টের জন্য খ্যাতি ও সুনামের চেয়ে তাদের সম্পদ ত্যাগ করা কঠিন। আরও অনেকে আছেন যারা বিভিন্ন প্রকারের জৈব আকাক্সক্ষা/ক্ষুধা বা রুচি/পছন্দের বাসনা পরিত্যাগ করতে কঠিন পরিক্ষার মধ্যে পড়েন। অব্রাহাম ঈশ্বরের আদেশে নিজের দেশ ত্যাগ করেন, কিন্তু তিনি ধনবান হন, বিখ্যাত হন। মোশী রাজপ্রাসাদের পরিমার্জিত সুখভোগ ও বিশেষ ব্যক্তিত্ব/সম্মান পরিত্যাগ করেন, আর অধপতনে যাওয়া, দুর্ধর্ষ, একগুয়ে, অবাধ্য লোকদের তিনি ধৈর্য্যসহকারে পরিচালনা করেন। এলিও-র মাধ্যমে ঈশ্বরের আহ্বানে ইলিশায় তার সম্পত্তি ত্যাগ করেন। পৌল একজন বড় রব্বি হওয়ার আশা ত্যাগ করেন। সবকিছুই খ্রীষ্টের মৃত্যুর উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করতে হয় যদিও অনেকের বাস্তবে বা সত্যিকারে তা করতে হয় না।”

লূক ১৪:২৫-২৭ ও ৩৩ পদে লেখা আছে। “তিনি মুখ ফিরাইয়া তাহাদিগকে কহিলেন, যদি কেহ আমার নিকটে আইসে, আর আপন পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভ্রাতৃগণ, ও ভগিণীগণকে এমন কি নিজ প্রাণকেও অপ্রিয় জ্ঞান না করে, তবে সে আমার শিষ্য হইতে পারে না।” ৩৩ পদ “ভাল, তদ্রুপ তোমাদের মধ্যে যে কেহ আপনার সর্বস্ব ত্যাগ না করে, সে আমার শিষ্য হইতে পারে না।”

২২ পদ - এই যুবকটি যীশুকে একেবারে তার আয়ত্বে বা তার অধিকারে আনতে চেয়েছেন। সে তার সমস্ত সম্পত্তির কিছুই না হারিয়ে একেবারে সবকিছুইসহ অনন্ত জীবন চেয়েছেন। জাগতিক সমস্ত কিছু নিয়েই তিনি স্বর্গে যেতে চেয়েছেন। “বস্তুতঃ মনুষ্য যদি সমুদয় জগৎ লাভ করিয়া আপন প্রাণ খোয়ায়, তবে তাহার কি লাভ হইবে? কিম্বা মনুষ্য আপন প্রাণের পরিবর্তে কি দিতে পারে? কেননা যে কেহ এই কালের ব্যভিচারী ও পাপিষ্ঠ লোকদের মধ্যে আমাকে ও আমার বাক্যকে লজ্জার বিষয় জ্ঞান করে, মনুষ্য পুত্র তাহাকে লজ্জার বিষয় জ্ঞান করিবেন, যখন তিনি পবিত্র দূতগণের সহিত আপন-পিতার প্রতাপে আসিবেন।” মার্ক ৮:৩৬-৩৭ পদ।  

তিনি খ্রীষ্টের কথা গ্রহণে লজ্জিত ছিলেন। প্রভুর কাছ থেকে ফিরে চলে যাওয়ায় এই ধনী যুবক নেতার প্রথম দু’টি আজ্ঞা লঙ্ঘন করার বিষয়টি একটু চিন্তা করে দেখুন - “আমার সাক্ষাতে তোমার অন্য দেবতা না থাকুক। তুমি আপনার নিমিত্ত খোদিত প্রতিমা নির্মাণ করিও না; . . . তুমি তাহাদের কাছে প্রণিপাত করিও না, এবং তাহাদের সেবা করিও না . . . ” যাত্রাপুস্তক ২০:৪-৫ পদ। মথি ২২:৩৬-৪০ পদে লেখা আছে “গুরু, ব্যবস্থার মধ্যে কোন্ আজ্ঞা মহৎ? তিনি তাহাকে কহিলেন, তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত মন দিয়া তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে, . . . এই দু’টি আজ্ঞাতেই সমস্ত ব্যবস্থা এবং ভাববাদীগ্রস্থও ঝুলিতেছে।”

কঠিন হৃদয় ধন-সম্পদকে গুরুত্ব দেয় ও ধনের সংগ্রহে ছুটাছুটি করে বেড়ায়। জগত আজ অর্থের পিছনে ছুটছে। কে অল্প সময়ে কত বেশি অর্থ আয় করতে পারে তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলছে। তাই বড় চাকরি, মোটা বেতন, বড় পদ, বড় সম্মান তাদের একমাত্র কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। তারা অনন্ত আশীর্বাদ পেতে চায় কিন্তু ধন-সম্পদ ত্যাগে নয়। ফলে তাদের এই কঠিন হৃদয় নিজের ভুল ক্রটিকে চিনতে পারে না। একদিন তাদের আশীর্বাদ ছেড়ে যেতে হয় অভিশাপের পথে। ধন-সম্পদই তাদের অভিশাপকে বেছে নিতে প্ররোচিত করে।

স্বর্গে যাবার জন্য আমাদের অর্থের লোভ করলে চলবে না। অর্থের মোহ আমাদের কাটাতেই হবে। অথচ প্রত্যেকেই স্বর্গে যাবার স্বপ্ন দেখে, যেমন ধনী ব্যক্তি যীশুর কাছে ছুটে গিয়েছেন। স্বর্গে যাবার জন্য শুধু দশ আজ্ঞা নয়, ঈশ্বর যা দেখান, যা বোঝান, যে কাজ করতে বলেন, যা কিছু ত্যাগ করতে বলেন সবই আমাদের শোনা ও পালন করা উচিত। ধনী ব্যক্তি স্বর্গে যেতে আগ্রহী, তিনি ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় রীতি নীতিও পালন করেন অথচ, যীশুর একটি নির্দেশ সে মেনে নিতে পারলেন না। অর্থের প্রয়োজন নিশ্চয় আছে কিন্তু সেই অর্থই যেন আমাদের জীবনে অভিশাপ না হয়ে যায়।

ধনীর পক্ষে স্বর্গরাজ্যে যাওয়া কত কঠিন, এ বিষয়টি যীশু তাঁর শিষ্যদের কাছে তুলে ধরেছেন। ঐশ্বরিক জীবন লাভে ধন-সম্পদ একটি বিশেষ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ধন-সম্পদ বিশ্বাসী জীবনকে আত্মিকভাবে পঙ্গু করে দেয় (মথি ১৩:২২ পদ) বিশ্বাসীর অন্তরে যে বীজ (বাক্য) বোনা হয়, ধন-সম্পদের মোহে সেই বীজ বৃদ্ধি পেতে পারে না। কঠিন হৃদয়ের লোকেরা বাইবেল পাঠক হলেও কার্যকারী হতে পারে না, ধনী যুবকের মত ধর্মাচরণ, ধর্মকর্মেলিপ্ত থেকেও ধর্মময়ের কাছ থেকে তারা দূরে যাবে। হিতোপদেশ ২৩:৪ পদে লেখা আছে, “ধন সঞ্চয় করিতে অত্যন্ত যতœ করিও না।” ৫ পদে, “তুমি কি ধনের দিকে চাহিতেছ, দেখ তাহা আর নাই, কারণ ঈগল যেমন আকাশে উড়িয়া যায়, তেমনি ধন আপনার জন্য নিশ্চয়ই পক্ষ প্রস্তুত করে।” অতএব আমাদের দৃষ্টি প্রভুর দিকেই থাকা প্রয়োজন।

প্রশ্ন থাকতে পারে যে, শুধু দরিদ্ররাই কি ঐশরাজ্যের অধিকারী হবে? ধনীদের কোনো সুযোগ নেই? বাইবেলে অনেক ভক্তের জীবনে দেখেছি সম্পদের প্রাচুর্য, ধনের অগাধ ভা-ার। অব্রাহাম, ইয়োব, শলোমন সকলেরই ধন-সম্পদ ছিল। যারা কি-না ভয়ের সঙ্গে, বাধ্যতার সঙ্গে ধন ব্যবহার করেছেন, উপচে পড়া প্রাচুর্য ঈশ্বর তাদের দান করেছেন।

“. . . অদ্য যদি তোমরা তাঁহার রব শ্রবণ কর, তবে আপন আপন হৃদয় কঠিন করিও না  . . ” ইব্রীয় ৩:৭-৮ পদ।

Comments

Popular posts from this blog

উপবাস - বাইবেলের আলোকে উপবাস

প্রতিমা পূজা এমনকি মূর্তি সম্পর্কে বাইবেল কী বলে? What does the Bible says about idolatry or even image?

ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করেছেন?