বড়দিন - খ্রীষ্টোৎসব। যীশুর জন্মদিনের ইতিকথা

খ্রীষ্টিয়ান সমাজের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব খ্রীষ্টমাস অর্থাৎ খ্রীষ্টের জন্ম উদ্যাপনের দিন। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিদাতা খ্রীষ্টের জন্মদিন পালন করা হয়। স্পষ্টভাবে জানা যায় যে এই উৎসবটির উৎপত্তি মূলত রোমান কাথলিকদের থেকে। রোমান কাথলিক মণ্ডলীর দ্বারা প্রথানুযায়ী পালন করা থেকে এখন এটা প্রচলন হয়ে আসছে, পেয়েছে জনপ্রিয়তা আর কাথলিক আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও প্রথার মতো অন্যান্য মণ্ডলীতেও একইভাবে উৎসবটি পালন করা হচ্ছে। অনেকেই জানতে চান যে, “আমাদের কি গতানুগতিক প্রথানুযায়ী এবং সবরকম রীতিনুযায়ী বড়দিন উদ্যাপন করা উচিত কি না? বড়দিন উদ্যাপনের সব রকম আয়োজন দেখতে কি অত্যন্ত জাগতিকতার মতো মনে হয় না! বড়দিন পালন করতে গিয়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান করা হয়, তার অনেক কিছুই কি পৌত্তলিকতা নয়?” তাই এক্ষেত্রে আমি আমাদের পূর্ব খ্রীষ্টিয়ানদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু ঘটনা থেকে উত্তর দেবার চেষ্টা করছি। 

 সান্তা ক্লজ এর উৎপত্তি (সাধু নিকোলাস) 

রোমান কাথলিক পৌরাণিক কাহিনী থেকে ‘সান্তা ক্লজ’ পালন বা উদ্যাপন করা হয়। সাধুদের বিষয়ে নিকোলাস এর ‘সাধু’ সম্পর্কে কাথলিক পকেট ডিকসনারি এবং অন্যান্য আরো কিছু তথ্য থেকে জানা যায় যে, সান্তা ক্লজ (Santa Claus) নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন (আজকের দিনে লোকেরা যাকে জানেন, তিনি সেই নন্)। আসল সান্তা ক্লজ একজন প্রচারক ছিলেন। তার নাম ছিল সাধু নিকোলাস (St. Nicholas), আর তিনি মায়রা (Myra) নামে বর্তমানে টার্কি দেশের একটি শহরে বাস করতেন, আর বিশপরূপে কাজ করতেন। তার বংশ-কুল বলছে তিনি পাটারা (Patara) সমুদ্রবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তিনি যুবক ছিলেন, তখন তিনি মিশর ও প্যালেস্টাইন দেশ ভ্রমণ করেন। শেষমেষ তিনি মায়রাতে একটি মণ্ডলীর বিশপ হয়েছিলেন। সম্রাট ডায়োক্লিসিয়ানের দ্বারা খ্রীষ্টিয়ানদের লাঞ্ছিত ও নির্যাতনের সময় তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। কিন্তু তিনি ডায়োক্লিসিয়ানের উত্তরাধিকারী সম্রাট কন্স্টাণ্টাইনের দ্বারা মুক্তি পান।

৩৪৫ সালের ৬ই ডিসেম্বরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে তার সমাধি স্মৃতিচিহ্নরূপে মায়রাতে সুপরিচিত ছিল। তিনি খ্যাতি লাভ করেন তার উদারতা, মহত্ত্বতা ও পরোপকারীতার জন্য। তার জনপ্রিয়তা পশ্চিমে আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১০৮৭ সালে তার স্মৃতিচিহ্নরূপে সংরক্ষিত অবশিষ্ট দেহাবশেষ ইতালির বারি (Bari) নামক স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। তার স্মৃতিচিহ্ন মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় রীতিনীতি অনুযায়ী তার সম্মানে জনসাধারণের জন্য বড় আকারে একটি তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তার প্রতি ভক্তি ও আরাধনা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর তিনি রাশিয়া ও গ্রিসের পছন্দসই একজন রক্ষক সাধুপুরুষ ছিলেন। ইউরোপের বহু মণ্ডলীর নামকরণ তার নামে করা হয়। ৬ ডিসেম্বর তার উদ্দেশ্যে পর্ব দিবসরূপে স্থির করা হয়। তিনি অনেক আশ্চর্যজনক কাজ করেন। তিনি একটি গরীর লোককে কয়েক ব্যাগ ভর্তি সোনা যৌতুকরূপে তার তিন কন্যাদের জন্য যোগার করে দেন। তিনি ছিলেন বন্দিদের রক্ষক। তিনি ছিলেন ঝড়ে-পড়া সৈনিকদের রক্ষক, কারণ তিনি লাইসিয়া (Lycia) উপকুল থেকে কিছু দূরে সমুদ্রগামী সর্বনাশা নাবিকদের সঙ্কটের সময় আশ্চর্যজনকভাবে তাদেরকে রক্ষা করেছেন। ডাচদের দ্বারা Saint Klaes এর নামের স্থলে Santa Claus (সান্তা ক্লজ) নামটিতে পরিবর্তিত করে শিশুদের ঐ সাধু নিকোলাসের নামে বড়দিনের উপহার দেবার জন্য রীতি পালন করানো হয়, আর পরে বিষয়টি এক সময় তার সাধু পর্ব-দিবসরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মৃত্যুদিবস ভালোবাসার উপহার দানের প্রথায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে খ্রীষ্টিয়ানেরা সাধু নিকোলাসকে (Nicholas) অবলম্বন করে বড়দিন অর্থাৎ খ্রীষ্টের জন্ম উদ্যাপন করে। আর আগে না-কি তার লাল পোশাকও ছিল না। ওটা না-কি একবার কোকাকোলার বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে তাকে পরানো হয়েছিল! ব্যবসার কত কাণ্ড, কী কাণ্ড! আবার প্রাক খ্রীষ্টান যুগে নর্স পুরাণের ওডিন ছিলেন প্রধান দেবতা। ওডিনের ছিল লম্বা সাদা দাড়ি। ওডিনের নামানুসারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উৎসব ও উপহার দানের প্রথা ছিল। ওডিন অনেক সময় ঘরের চিমনি দিয়ে নেমে আসতেন আর উপহার রেখে যেতেন। পরবর্তীতে খ্রীষ্টান যুগে সেই প্রথাই বদলে যায় বড়দিনে উপহার দানের প্রথায়। ওডিনের ছাপ পড়ে সান্তা-ক্লজের উপর। সান্তা-ক্লজ সারাবিশ্বে বর্তমানে ক্রিসমাস উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রিসমাসের রীতি ও লোকাচারের সঙ্গে মিশে গেছেন সান্তা-ক্লজ।

বিষয়টি অবশ্যই এর মধ্যে দিয়ে খেয়াল করতে হয় যে, সান্তা ক্লজের এই বিষয়টি সত্যিকারে খ্রীষ্টিয় বিশ্বাস, জীবন-আচার আচরণের বিপরীত ব্যবহার।

একজন হিন্দু ধর্মের লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে তিনি মনে করতেন খ্রীষ্টিয়ানদের ঈশ্বর হলো সান্তা ক্লজ, আর সান্তা ক্লজের (খ্রীষ্টমাস ফাদারের) একজন পুত্র ছিল যিনি খ্রীষ্টিয়ানদের মুক্তিদাতা ঐ শিশু যীশু। বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই এ ধরনের সত্যে আবদ্ধ থেকে প্রকাশ্যে খ্রীষ্টিয়ান হওয়ার দাবি করেন; আর এর কারণে তারা খ্রীষ্টিয় বিশ্বাস, জীবন-আচার আচরণের বিপরীত ঐ ধরনের সহজ ও নির্বোধ রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার অনুসরণ করে আসছেন।

কীভাবে ২৫শে ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন বলে উদ্যাপদের দিন হলো।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে ‘যীশু কি আমাদের কাছ থেকে এই আশা করেন না যে আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করি? বাইবেল যীশুর জন্মদিন সম্পর্কে কী বলে?” কিছু কিছু পার্থক্য ও অমিল ছাড়া - কাহিনীটি সাধারণত এরকম দাঁড়ায় যে : “যীশু ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং মেষপালকদের সঙ্গে আবার আরও তিন জন পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর জন্ম উদ্যাপন করতে, শিশু যীশুকে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতে তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিন জন পণ্ডিত ব্যক্তি বড়দিনের উপহারস্বরূপ সোনা, ধূপধুনো ও গন্ধনির্যাস দিয়েছিলেন। রাখালেরা তাদের মেষপালের কাছে ফিরে গেলেন, পণ্ডিতেরা হেরোদের ভয়ানক ক্রোধ থেকে সতর্ক হলেন এবং শিশু যীশুকে দেখার পর অন্য পথ দিয়ে তাদের দেশে চলে গেলেন। এরপর আমরা দেখতে পাই যে শিশু যীশুসহ যোষেফ এবং মরিয়ম থাকার জন্য বৈৎলেহেম ত্যাগ করে মিশরে চলে গেলেন আর সেখানে কিছুদিন থাকার পরে তারা নাসরৎ নামে একটি স্থানে গেলেন।” কিন্তু বিষয়টি এখনো পর্যন্ত বেশ ভ্রান্তই থেকে গেল। তবুও আজ অনেকেই চিরাচরিত কাথলিক শিক্ষা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি তোলে না। এজন্য এই রহস্যের পৌরাণিক কাহিনী পূর্ণ সমর্থন করা হচ্ছে। যা-হোক এই কাহিনীটি আসলেই সেরকমভাবে কী ঘটেছিল তা আজ আমাদের জানা একান্ত প্রয়োজন। এর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বাইবেলের ব্যাখ্যানুযায়ী আসলে কী হয়েছিল? আপনার বাইবেল খুলুন এবং লূক দুই অধ্যায়ের সাথে মথি দুই অধ্যায় পাঠ করুন।

লূক ২:১ পদে আমরা পাঠ করে দেখতে পারি যে সেখানে অগাস্টাস সীজার (কৈসর) ঐ সময়ে পৃথিবীর সমস্ত লোকদের নাম লেখাবার আদেশ দিলেন। সিরিয়ার শাসনকর্তা কুরীণিয়ের সময় এই প্রথমবার লোকগণনার জন্য নাম লিখবার ব্যবস্থা করেন (৫ পদ)। যোষেফ এবং মরিয়ম নাম লিখবার জন্য নাসরৎ নগরে তাদের ঘর ত্যাগ করে বৈৎলেহমে গেলেন। যেখানে তারা পশুর আস্তাবলে থাকার জন্য জায়গা নিলেন, মরিয়ম যীশুর জন্ম দিলেন এবং যাবপাত্রে তাঁকে শুইয়ে রাখলেন (লূক ২:৭ পদ)। এ অংশটি পাঠ করে জানা যায় যে তিনি কোনো যাবপাত্রে জন্মগ্রহণ করেন নাই। যখন যীশু জন্মগ্রহণ করেন তখন ঐ অঞ্চলের রাখালেরা রাতে মাঠে নিজেদের পাল চরাচ্ছিলেন যখন তারা শুনেছিল খ্রীষ্ট সেই প্রভু জন্মগ্রহণ করেছেন (লূক ২:৮-১১ পদ)। “ঐ অঞ্চলে মেষপালকেরা মাঠে অবস্থিতি করিতেছিল, এবং রাত্রিকালে আপন আপন পাল চৌকি দিতেছিল” (লূক ২:৮ পদ)। যীশুর পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় বেথলেহেমের প্রচণ্ড শীতে ঐ অঞ্চলে রাতে পালকের পক্ষে মেষ চৌকি দেয়া অসম্ভব। জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের ঐ সকল অঞ্চলে গ্রীষ্মকালেই রাতের বেলা মেষ চরানো হয়ে থাকে। কারণ দিনের বেলায় প্রচণ্ড রৌদ্রতাপে মরুভূমিতে মেষ চরানো সম্ভবপর নয়। যিহূদীয়া অঞ্চলে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে সমস্ত মেষ নিরাপদ আশ্রয়স্থানে নিয়ে আসা হতো। কারণ ওখানকার মেষপালকেরা সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত খোলা মাঠে মেষপাল সংরক্ষণ করেন। কিন্তু শীতকালে (নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে) ঝড়বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা হাওয়ায় কেউই মাঠে মেষপাল রাখেন না বরং সুরক্ষিত আশ্রয়েই রাখেন। লূকের বর্ণনার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিশপ বার্নস তার প্রণীত ‘দি রাইজ অব দি খ্রীস্টিয়ানিটি’-এর ৭৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘তদুপরি যীশুর প্রকৃত এবং সঠিক জন্ম তারিখ যে ২৫ ডিসেম্বর ছিল এই বিশ্বাসের নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত দলিল নেই। বেথলেহেমের কাছাকাছি খোলা মাঠে মেষপালক রাখালদের রাত্রে পাহারাবত অবস্থা সম্বন্ধে লূকের বর্ণিত জন্মকাহিনী যদি আমরা বিশ্বাস করি তাহলে যীশুর জন্ম শীতের মৌসুমে হয়নি, যখন জেরুজালেমের পার্বত্য এলাকায় তাপমাত্র একেবারে নিচে নেমে যায় এবং ডিসেম্বর ও জানুয়ারীর রাতে প্রবল শীতে তুষারপাতের ফলে তখন মেষ চরানো কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।’ সে-সময় মেষপালকরা যখন ওদের মেষপাল নিয়ে উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করছিলেন - তার মানে এটাই প্রমাণ করে যে ‘প্রভু’ ২৫শে ডিসেম্বর কিংবা শীতকালে নিশ্চয়ই জন্মগ্রহণ করেননি, কিন্তু তার আগেই সেপ্টেম্বরের শেষে কিংবা অক্টোবরের প্রথমদিকেই - শরৎকালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। লূকের বিবরণ থেকে এটিই প্রমাণিত হয়, আর আমরাও এতে নিশ্চিত হতে পারি যে, যীশু শীতকালে এবং ২৫শে ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেননি। সেজন্যই ২৫শে ডিসেম্বরের চিন্তা সম্পূর্ণ বাদ দেয়াই যুক্তিসঙ্গত। 

আরও বলতে হয় যে এই রকম শীতের মাসে যখন ভ্রমণ করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য তখন অগাস্টাস সীজার (কৈসর) এই সময়ে পৃথিবীর সমস্ত লোকদের নাম লেখাবার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে আসার জন্য এরকম ঘোষণা কখনোই করতে যাবেন না (লূক ২:১-২ পদ)। শীতকালে যিরুশালেমের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যায়, বৃষ্টিতে রাস্তা, পথঘাট - সবই নোংরা অপরিষ্কার, জলকাদায় কর্দমাক্তও হয়ে যায়, এছাড়াও যিরুশালেমে কখনো-কখনো বরফও পড়ে। ঐ সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করা কিংবা ভ্রমণ করা দুরবস্থা, বিশেষ করে সন্তানসম্ভাবা স্ত্রীলোকদের জন্য নিশ্চয়ই ক্ষতিকর ও বিপদজনক সময়। এ ব্যাপারে একজন ‘গ্রন্থকার’ মন্তব্য করেছিলেন, কর্তৃপক্ষ (রোমানরা) কখনোই কোনো জনসম্পর্ক-ব্যবস্থা কিংবা আদমশুমারির ব্যবস্থা নিশ্চয়ই শীতকালে করতেন না, বিশেষ করে জনসাধারণকে যদি দূরদূরান্ত থেকে ঝড়, বৃষ্টি, বন্যার মধ্যে যাতায়াত করতে হতো, কারণ ঐ সময় যাতায়াত করা একদিকে যেমন অপ্রীতিকর, বিরক্তিকর অন্যদিকে ঠিক তেমনি বিপদজ্জনকও বটে। এছাড়াও শীতকালে যিরুশালেমে যখন-তখন বরফও পড়ে। যতটুকু জানা যায়, প্রথম শতাব্দীর দিকেও যিহূদীয়ায় একবার আদমশুমারির ব্যবস্থা করেছিল, সেটিও শরৎকালেই ছিল। এতেই যথেষ্ট প্রমাণিত হয় আর চূড়ান্তভাবে বাইবেল প্রমাণ করে দেখায় যে যীশু শীতকালে জন্মগ্রহণ করেন নাই কিন্তু তিনি প্রায় সেপ্টেম্বরের মাঝে জন্মগ্রহণ করেছেন!

যোহন বাপ্তাইজকের পিতা সখরিয়, ৮ম ধারা (Abijah/অবিয়) এ সময় ধর্মধামে পরিচর্যা করেছিলেন যা ইহূদী পঞ্জিকাতে Iyar ২৭ থেকে Sivan 5 পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং সর্বাধিক এক সপ্তাহ পর্যন্ত। আমাদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা জুন মাসের ১ তারিখ থেকে জুন মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত (১ বংশাবলি ২৪:৫-১৯; ২৭:১,২ Josephus) পরিচর্যার পরবর্তী সপ্তাহে সখরিয় বাড়ি ফেরেন, তার স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে পড়েন (লূক ১:২৩ এবং ২৪ পদ) এবং নয় মাস পরে মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে যোহন জন্মগ্রহণ করেন। যীশু যোহনের থেকে ছয় মাসের ছোট (লূক ১:২৬-৩৬ পদ)। তাঁর জন্ম অবশ্যই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় হয়েছিল। এমনকি যীশুর পূর্ণ সাড়ে তেত্রিশ বছর বয়সে বসন্তকালে তাঁকে ক্রুশে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, শরৎকালে জন্মগ্রহণ করলে শীতকালে নয়। সুতরাং যীশুর ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করার ধারণাটি অযৌক্তিক! সহজ বিষয় হলো যে, যীশু যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, শাস্ত্রের লেখকগণ স্পষ্টভাবে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, যীশুকে কিংবা তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন করতে বলা হয়নি।

যাহোক, মেষপালকেরা তৎক্ষণাৎ চলে এলেন (লূক ২:১৬ পদ), সত্য-সত্যই তারা যীশুর ত্বকছেদের আগেই পৌঁছালেন, আর যাবপাত্রে যীশুকে শোয়ানো দেখতে পেলেন। যীশুর জন্মের আট দিন পরে তাঁর ত্বকছেদ করা হলো এবং নাম রাখা হলো (২১ পদ)। মরিয়মের শুচি হবার পরে, সর্বমোট ৪১ দিনে (লেবীয় ১২:৪ পদ) পরিবারটি যিরূশালেমে প্রভুর বিধি-ব্যবস্থা পালন করতে এসেছিলেন (২ এবং ৩ পদ)। যীশুর বয়স যখন ছয় সপ্তাহের কাছাকাছি তখন তাঁকে ধর্মধামে নিয়ে আসা হয়েছিল। শিমিয়োন পবিত্র আত্মার আবেশে প্রভু খ্রীষ্টকে দেখতে এসেছিলেন “শিশু যীশুর পিতামাতা যখন তাঁহার বিষয়ে ব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী কার্য করিবার জন্য তাঁহাকে ভিতরে আনিলেন” (২৬ ও ২৭ পদ)। হান্না নামে একজন ভাববাদিনী ছিলেন, আর তিনিও একই সময়ে এলেন (৩৬-৩৯ পদ) এবং প্রভুকে ধন্যবাদ দিলেন। এরপর সেভাবে তারা রীতি-ব্যবস্থা অনুযায়ী সমস্ত কর্ম সম্পাদন করার পর  “. . . তাহাদের নিজ নগর নাসরতে ফিরিয়া গেলেন” (৩৯ পদ)। কিন্তু পণ্ডিত ব্যক্তিগণ তখনো আসেন নাই!

এই পবিত্র পরিবারটি নাসরতে থাকলেন এবং দুই বছরের মতো সময় কেটে গেলে সেই পণ্ডিত ব্যক্তিগণ শেষমেষ তাদের অতিকষ্টের দীর্ঘ যাত্রা সমাপ্ত করলেন। কিন্তু তারা যীশুকে বৈৎলেহমে দেখতে পাননি যেমন অতীতের ঐ চিরাচরিত কাহিনী শিক্ষা দেয়। তারা যীশুকে শিশুরূপে যাবপাত্রে পাননি কিন্তু এর পরিবর্তে তারা নাসরতে তাঁকে স্বল্পবয়স্ক বা কমবয়সী একটি বালকরূপে দেখতে পেয়েছিলেন (নবজাতক শিশুরূপে নয়)! এখন আমরা মথি দুই অধ্যায় খুলে দেখি যে বাইবেল কী বলছে, আর কাথলিক চিরাচরিত গল্প ভুলে যাই যা আমরা অন্ধের মতো বহুদিন যাবৎ গ্রহণ করে আসছিলাম।

“হেরোদ রাজার সময়ে যিহূদিয়ার বৈৎলেহমে যীশুর জন্ম হওয়ার পর, দেখ, পূর্বদেশ হইতে কয়েকজন পণ্ডিত যিরূশালেমে আসিয়া কহিলেন” (মথি ২:১ পদ)।

মথি ২:১ পদে অন্যত্র ব্যবহৃত কিছু কিছু গ্রিক শব্দ থেকে মূল গ্রিক পাঠে দেখানো “born/জন্ম হইলে পর” এবং "came/ আসিয়া (এসে)” শব্দগুলো কিছুটা ভিন্নতর। ১ম পদে ব্যবহৃত শব্দগুলো এবং পণ্ডিতগণের আগমনের প্রকৃত দিনের মধ্যে সময় অতিক্রম হওয়ার একটি ইঙ্গিত বহন করে। অবশিষ্ট পাঠ থেকে এটি স্পষ্ট যে যীশু যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন পূর্বদেশে তারাটির প্রথম দেখা এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের যিরূশালেম আগমনের মধ্যে বেশ কিছু দিন ও সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এখানে লক্ষ্য করুন যে তারাটি পণ্ডিতদের বৈৎলেহমের দিকে নয় বরং যিরূশালেমের দিকে পরিচালিত করেছে। এটি করা হয়েছে ঈর্ষাপরায়ণ হেরোদ রাজাকে সত্যিকার রাজার জন্মগ্রহণের বিষয়টি জানানোর জন্য, যাতে তাঁকে হত্যা করতে হেরোদকে ক্রোধান্বিত করে আর এভাবে পরিবারটাকে মিশরে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় যেন এভাবে হোশেয়ের ভাববাণী (১৫ পদ) এবং যিরমিয়ের ভাববাণী (১৭ ও ১৮ পদ) পরিপূর্ণ হয়।        

হেরোদ যখন জানতে পারলেন যে একজন নতুন রাজা জন্মেছেন এবং পণ্ডিতদের কাছে আকাশের তারাটি তাঁর জন্মের সংবাদ ঘোষণা করছে, তখন তিনি এই সমস্ত বিষয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন এবং তার সঙ্গে সমস্ত যিরূশালেমও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল (২ ও ৩ পদ)। সেই রাজা কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন তা জানার পরে (৪-৫ পদ), হেরোদ  “ঐ তারা কোন্ সময়ে দেখা গিয়াছিল, তাহা তাঁহাদের নিকট হইতে বিশেষ করিয়া জানিয়া লইলেন” (৭ পদ)। হেরোদ রাজাকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে ঐ তারাটি প্রায় দুই বছর আগে দেখা গিয়েছিল! কারণ তিনি তাদেরকে কোনো নবজাতক শিশুকে নয় বরং “স্বল্পবয়স্ক” অর্থাৎ কমবয়সী একটি বালকের খোঁজে পাঠিয়েছিলেন। তাছাড়া, যখন তিনি সমস্ত বালক সন্তানদের হত্যা করেছিলেন, সে সময়ে “তদনুসারে দুই বৎসর ও তাহার অল্প বয়সের যত বালক বৈৎলেহমে ও তাহার সমস্ত পরিসীমার মধ্যে ছিল, লোক পাঠাইয়া সেই সকলকে বধ করাইলেন” (১৬ পদ)।

মীখার ভাববাণী হেরোদকে বলার পরে (৬ পদ) তিনি পণ্ডিতদের বৈৎলেহমে পাঠিয়ে দিলেন।

পণ্ডিত ব্যক্তিরা কিন্তু বৈৎলেহমে যাবপাত্রে যীশুকে দেখতে যান নাই!

হেরোদ যেভাবে পণ্ডিত ব্যক্তিদের আদেশ করেছিলেন তাদের সেভাবে “কষ্ট করে খোঁজ করতে” হয় নাই (৮ পদ), কারণ ঐ তারাটি তাদের কাছে আবারো উদয় হয়েছিল আর তাদেরকে পরিচালনা দিচ্ছিল আসলে সেই দিকে, যেখানে ঐ “স্বল্পবয়স্ক বা কমবয়সী একটি বালক/young child” ছিলেন (৯ পদ)। পণ্ডিত ব্যক্তিগণ হেরোদের নির্দেশনায় নয় কিন্তু ঐ তারার অনুসরণ করে চলছিলেন। পণ্ডিতেরা নাসরতে গিয়েছিলেন, কারণ যীশু ছয় সপ্তাহ বয়স থেকে সেখানে বাস করছিলেন (লূক ২:৩৯ পদ) এবং একটি ঘরে ছিলেন, কিন্তু কোনো যাবপাত্রে নয় (মথি ২:১১ পদ)।

এ সম্পর্কে আরও বলা যায় যে, যোহন বাপ্তাইজকের দিক থেকে যীশুকে প্রায় দুই বছর বয়সে পাওয়া যায়। যীশু যোহনের থেকে ছয় মাসের ছোট ছিলেন (লূক ১:৩৬ পদ)। হেরোদ যখন দুই বৎসর ও তার অল্প বয়সের (নবজাতক শিশুদের নয়) সমস্ত বালকদের হত্যা করার আদেশ দিলেন (মথি ২:১৬ পদ), যীশু ঐ বয়সের মধ্যে থাকায় ভয় ও আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন বিধায় নিরাপত্তার জন্য তাঁকে মিশরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (মথি ২:১৩ পদ)। যদিও সেরকম কোনো নথি নেই যে যোহন বাপ্তাইজককে ঐভাবে পালিয়ে যেতে হয়েছিল বা নিরাপদ দূরত্বে রাখা হয়েছিল এবং তার কোনো ক্ষতি না হয় সেই অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। কিন্তু কেন যোহনকে সেরকম অবস্থায় পড়তে হয়নি? বিষয়টি পরিষ্কার, যোহন বাপ্তাইজক দুই বছরের বড় ছিলেন এবং তিনি ভীতিকর ও আশঙ্কাজনক বয়স পেরিয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণে, যীশু ছয় মাস ছোট থাকায়, কমপক্ষে তাঁর এক বছর ছয় মাস বয়স ছিল অথবা পণ্ডিত ব্যক্তিদের দর্শন করার মতো বয়স সেই সময় ছিল আর সম্ভবত দুই বছর বয়সের কাছাকাছি ছিল (মথি ২:১৬,১৭ পদ)।

আপনি অনেক গির্জাঘরে, স্কুলে ও অনেকের বাড়িতে তাদের ঘরে টাঙানো যীশুর জন্মবিষয়ক চিত্র দেখেছেন (nativity scenes) এবং সে বিষয়ে ভালো জ্ঞান ও ধারণা আপনার আছে। এ দৃশ্যে আপনি দেখে থাকেন যাবপাত্রে শিশু যীশু শোয়ানো, তাঁর মাথা ঘিরে আঁকা আলোকের বলয়, তাঁর উপর একটা উজ্জ্বল তারা রয়েছে, দূতগণ তাঁর পাশে রয়েছে, তাঁর মা ও যোষেফ তার কাছেই রয়েছে আর শিশুটিকে দেখছে, কয়েকজন রাখাল রয়েছে পাশে এবং তিনজন পণ্ডিত ব্যক্তি উপহার দিচ্ছে। শাস্ত্রানুযায়ী লক্ষ্য করলে বলতে হয় এই অনুমান সত্য। তবে শাস্ত্র কখনোই বলে না যে তিন (৩) জন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, একবারও সে কথা কখনোই উল্লেখ নাই! তাদের সংখ্যা অজানা আর এমনকি এও নিশ্চিত যে তারা কখনো বৈৎলেহমে যাবপাত্রের কাছে উপহার নিয়ে উপস্থিত হন নাই। এই কয়েকজন পণ্ডিতেরা যাত্রা করে যাবপাত্রে শোয়ানো এক নবজাত শিশুর কাছে পৌঁছে ছিলেন, যখন যীশু একটু বড়ো হয়ে গিয়েছিল - আর নবজাতক ছিলেন না, ‘শিশু’ যীশু আর তখন আস্তাবলে নয় বরং ঘরে ছিলেন। অন্যদিকে প্রচলিত জনপ্রিয় শিক্ষার বিপরীত কিংবা অমিল হলো যে, পণ্ডিত ব্যক্তিরা যীশুকে বড়দিনের উপহার দেন নাই, জন্মদিনের কোনো উপহার বা এ ধরনের সেরকম কোনো কিছুই নয়। এসব উপহার স্বর্ণ, কুন্দুরু (ধূপধুনো), গন্ধরস যা-কিনা “রাজার জন্য উপহার”। ঐসব দিনে তখন এই রীতি ছিল যে, যখন রাজাকে দর্শন বা সাক্ষাৎ করতে হয় তখন দর্শনার্থীদের ঐ ধরনের উপহার নিয়ে যেতে হয়। ১ রাজাবলি ১০:২ ও ১০ পদে উল্লেখ আছে যে শিবার রাণী যখন রাজা শলোমনের কাছে এসেছিলেন তখন তিনি সোনা ও সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এই পণ্ডিত ব্যক্তিরা আনুমানিক ৪০০০ মাইল অতিক্রম করে তারা ঠিক জন্মদিন উৎসব কিংবা বড়দিন উৎসব পালন করতে আসেন নাই, কিন্তু তারা যিহূদীদের রাজার দর্শন করতে এসেছিলেন (মথি ২:২ পদ)। লক্ষণীয় যে যীশুর জন্মদিন পালন করতে কিংবা যীশুর জন্ম বিষয়ক অমন চিত্রাঙ্কন করার এমন কোনো আদেশ মোটেও নেই, বাইবেলে কোথাও নেই। বরং, নতুন নিয়মে যীশু আমাদের তাঁর মৃত্যুকে স্মরণ করতে এবং সেই মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত সম্মান জানাতে আদেশ করেছেন। “ইহা আমার স্মরণার্থে করিও” (লূক ২২:১৯ পদ)।

আরেকটি প্রশ্ন প্রায়ই জানতে চাওয়া হয়, “কেন এই ২৫শে ডিসেম্বর? আমি আবারো বলি যে যীশু সম্ভবত এপ্রিল ও নভেম্বরের মধ্যে জন্মেছিলেন - আর না হোক, শাস্ত্র কি এমন কথা কোথাও বলে যে রাখালেরা কনকনে শীতের মাঠে আগুন জ্বালিয়ে তাদের পাল চরাচ্ছিল? কয়েক বছর আগে নামকরা কয়েকজন প্রচারক বাবুরা খ্রীষ্টের জন্মদিন সম্পর্কে আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে কথা হচ্ছিল যে, যীশুর জন্ম তারিখ সম্পর্কে স্পষ্টত কোনো নিশ্চয়তা নেই যে যীশু তিসরি (Tisri) অর্থাৎ হিব্রু বার্ষিক ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস : বর্তমান কালে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের কোনো এক অংশের ১৫তে জন্মে ছিলেন যা-কিনা কুটীরোৎসব/কুটীরবাস, বা হিব্রু "cukkah" (উচ্চারণ 'Sook-kaw')। তবুও সঠিক সম্ভাব্য বিষয় সম্পর্কে অনেক আলোচনায়, বহু বইপত্র, ওয়েব সাইট ঘাটিয়ে সবকিছু সঠিক নিরিক্ষণে স্থির নিশ্চিতে বলতে হচ্ছে যে, “আমরা জানি না কখন যীশু জন্মেছিলেন, এমনকি কোন্ বছরে তিনি জন্মেছিলেন তাও জানি না।” যীশু যিরূশালেমের কয়েক মাইল দক্ষিণে ছোট শহর বৈৎলেহমে জন্মেছিলেন বলে যখন আমরা মেনে নিয়েছি, সেখানে তাঁর জন্ম তারিখ, এমনকি নির্দিষ্ট কোনো বছরের নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। নতুন নিয়মে মথি ও লূক লিখিত সুসমাচারে তাঁর জন্মের সেই কাহিনীটি রয়েছে যা সেই ঘটনাটির পরে পরবর্তী ভিন্ন ভিন্ন কয়েক দশকে লেখা হয়েছিল, আর এই একটি কারণে বিষয়টি অনিশ্চিত। যীশুর জন্মদিন উদ্যাপন করার ইস্যুটিতে খ্রীষ্টিয় মণ্ডলী গত কয়েক শতাব্দী ধরে কিছুটা মনোযোগ দিতে শুরু করলো। খ্র্রীষ্টিয়ানদের মূখ্য পর্ব খ্রীষ্টের সেই পুনরুত্থানের দিনটি কিন্তু আগে থেকেই ছিল। এছাড়াও ধীরে ধীরে মণ্ডলী সেরকমভাবে যীশু খ্রীষ্টের জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলো স্মরণে রাখার জন্য পঞ্জিকা তৈরি করতে থাকলো। এতে তাঁর জন্মদিন পালনের বিষয়াটিও যুক্ত করা হলো।

প্রতি বছর মুক্তিদাতা খ্রীষ্টের জন্মদিন যে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে পালন করা হয় তা পৌত্তলিক বা নিকৃষ্ট এক ধর্মাবলম্বনকারীদের থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। মধ্য-শীতকালীন দক্ষিণ অয়নান্ত (২১ বা ২২ ডিসেম্বরের কাছাকাছি) বছর ঘুরে আসা নিদর্শন পৌত্তলিক ধর্মাচরণ থেকে এমন ঘটনা। সংক্ষেপে বলা যায় যে এর উৎপত্তি স্যার্টার্ন দেবতার উন্মত্ত আনন্দোৎসব Saturnalia থেকে। যে উৎসবটিতে সবাই উন্মত্ত হৈ-হুল্লোড়ে রত হতো; খ্রীষ্টের জন্মদিন পালন উৎসবের মধ্যে এ ধরনের অ-খ্রীষ্টিয় আচার-অনুষ্ঠান আজ মিশে গিয়েছে। এগুলোর ভেতর প্রাক্-খ্রীষ্টিয়ান যুগের বিভিন্ন লৌকিক ধর্মের কিছু আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। এ জাতীয় সংযোজন প্রথমে বড় আকারে ঘটে রোমের স্যাটার্নালিয়া উৎসবটি থেকে। অনেকের মতে আজকের বড়দিনের আনন্দমুখর দিকটা মূলত ঐ উৎসবটির কাছে ঋণী। যাহোক, এই স্যাটার্নালিয়া উৎসবটিকে ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল এবং ২৭৪ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট অরেলিয়ান (Aurelian) ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে অপরাজেয় সূর্যদেবের জন্মতিথি উপলক্ষে পৌত্তলিক উৎসবে পালন করতে বাধ্য করেন। এটি ছিল বিজয়ী সূর্যের বিধর্মী অনুষ্ঠান দিবস। আরও জানা যায় যে স্মরণীয় স্যাটার্নালিয়ার তারিখও ছিল ২৫ ডিসেম্বর। এই তারিখটি অবশ্য প্রথমাবধি খ্রীষ্টমাসের দিন বলে স্বীকৃত ছিল না। প্রথম দিকে যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন ধরা হতো ৬ই জানুয়ারি। এক পর্যায়ে এই তারিখ বদলে দাঁড়ায় ২৫ মার্চে, সবশেষে ২৫ ডিসেম্বরে। কিন্তু আর্মেনিয়ায় উৎসবটি আজও উদ্যাপিত হয় প্রথমোক্ত তারিখেইে। ৬ জানুয়ারি ছিল মিশরীয় সৌর উৎসব আর রোমান সন্ন্যাসী ডায়োনিয়াস (Dionysus) এ দিনটাকে ধর্মগতভাবে উৎসর্গ করেন। সম্রাট কন্স্টাণ্টাইনের অধীনে নীরবে সহ্য করা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণকারীদের দ্বারা ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন ও ৬ জানুয়ারি খ্রীষ্টিয় উৎসবরূপে দু’টি খ্রীষ্টধর্মানুগত পর্বোৎসব পালন করানো হতো।

অন্যান্য আরও কিছু তত্ত্বে জানা যায় যে, ২৫০-৩০০ বছর পর্যন্ত ভিন্ন একটি ধর্মের স্মরণীয় অনুষ্ঠান থেকেও খ্রীষ্টের জন্ম কিছুটা উদ্যাপিত হতো। খ্রীষ্টের মৃত্যু ও পুনরুত্থান সমস্ত নতুন খ্রীষ্টিয়ানদের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মণ্ডলী যেমন জগত জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো, তেমনি রোমান/ইউরোপীয় শীতকালীন দক্ষিণ-অয়নান্তের (সূর্যের দক্ষিণ গতির শেষ সীমা ২১ বা ২২ ডিসেম্বর) উৎসবটি বাধার মুখোমুখি হলো। জগতে পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীদের এটি একটি মহা সামাজিক উৎসবের দিন ছিল। কারণ যীশু খ্রীষ্টের জন্মের দিন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান তখন ছিল না, এ কারণে একটি দিনকে মনোনীত করতে হয়েছিল। ইস্টার্ন অর্থোডক্স আর সেই পূর্বাঞ্চল ধর্মগত অনুষ্ঠান পালনকারী মণ্ডলীর মধ্যে রোমান কাথলিক মণ্ডলী ৬ জানুয়ারি তারিখটি নির্ধারণ করলো। উৎসব দিনটির নামকরণ করা হয়েছিল ইপিফ্যানি (Epiphany), যার অর্থ “জন্ম বা আবির্ভাব”, খ্রীষ্টের প্রকাশ হওয়ার দিন। যার আরও ব্যাখ্যা হলো বৈৎলেহমে ঈশ্বরের অবতার রূপে শিশু যীশুর আত্মপ্রকাশের কালে প্রাচ্যদেশীয় তিন পণ্ডিতদের অর্থাৎ প্রাচীন জ্ঞানীজনের (Magi) আগমন উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠেয় খ্রীষ্টিয় উৎসব (উৎসব পর্বটি ২ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যবর্তী রবিবার)। বেশ প্রাচীনকাল থেকে এখনো পর্বটি পালন হচ্ছে। প্রাচ্য মণ্ডলীগুলো এই পর্বকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জানা যায় এখনো কোনো-কোনো দেশে এদিনে অনেক আনন্দ ও উপহার বিনিময় করা হয়। যাহোক, রোমে স্থাপনকৃত পশ্চিমস্থ মণ্ডলী ২৫ ডিসেম্বর মনোনীত করে। কোনো প্রাচীন রোমীয় পঞ্জিকা লক্ষ্য করলে বিষয়টি জানা যায় যে, বড়দিন সেভাবে পূর্বে খুব সম্ভব ৩৩৬ খ্রীষ্টাব্দে রোমে উদ্যাপিত হয়েছিল। প্রায় ৫৪৭ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি পোপ গ্রেগরীর দ্বারা সাধু আগস্টিনকে প্রথম মিশনারিরূপে ইংলান্ডে পাঠানো হয়েছিল। তিনি পোপের নির্দেশ অনুসরণ করে মেনে চলতেন, “লোকদের ধর্মীয় রীতিনীতি বা প্রথা, মন্দ বা অমঙ্গলজনকের মূল কারণ না হয়, তাদের অবশ্যই খ্রীষ্টিয় ধর্মের সাথে পরস্পর বেমালুম মিশে যেতে হবে” (প্রেরিত ১৫:১৯-২০ পদ)। পূণ্য ভূমির সেই মণ্ডলী নিয়মিতভাবে আমাদের প্রভুর জন্মদিন ৬ জানুয়ারি পালন করতে শুরু করেছিল। সাধু আগস্টিনের মণ্ডলী ২০ মে এটি পালন করতো। এখনো বিভিন্ন রকমের মণ্ডলী ২৫ মার্চ পালন করে।

৬২৫ খ্রীষ্টাব্দে মণ্ডলীর কেন্দ্রীয় নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ঈশ্বরের সেই পুত্রের জন্ম, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই জন্মটি - মণ্ডলী অবশ্যই সত্যসত্যই উদ্যাপন করবে, যেহেতু এখন পর্যন্ত লোকেরা ২৫ ডিসেম্বর সেই সূর্যের পুনঃজন্ম উদ্যাপন করছিল। সূর্য দেবতা সম্পর্কে সবরকম গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সাথে পূর্ব মণ্ডলী সত্যিকারে একটি সমস্যায় ছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কিছুটা সময় নিয়েছিল কিন্তু খ্রীষ্টধর্ম পালনের ক্ষেত্রে এটি বেশ প্রসার লাভ করেছিল। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের কৃষ্টি/সংস্কৃত্যায়ন থেকে বা Teutonic-Celtic paganism অর্থাৎ প্রাচীন জার্মানদের-কেল্ট জাতীয় ধর্মাচরণ থেকে প্রতীক, উপাসনা পদ্ধতি বড়সর করে শুরু করা হয়েছিল। জার্মানীয় দেবতা থিওর (Thor) শীতকালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং এই পৌত্তলিক বা নিকৃষ্ট ধর্মাবলম্বীর থেকে ইয়ুল (Yule log) আলোকসজ্জা অর্থাৎ আলোর উৎসব, সবুজ গাছপালা ও তা চুম্বন করা, বিশেষ বিশেষ খাবার ইত্যাদির ব্যবহার হতো। এসব বিষয় এখনো কিছু কিছু পৌত্তলিক ধর্মাচরণে উদ্যাপন হয়ে থাকতে পারে। কারণ দৃষ্টান্তস্বরূপ মূর্তি উপাসনাকারীদের শীতের প্রারম্ভে আলোকসজ্জার উৎসব রয়েছে যার বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল আলো, বিশেষ খাদ্য, উপহার আদান প্রদান করা। এনারা বলেন যে যারা ভালো লোক তাদের উপর আশীর্বাদ প্রদান করতে অনুষ্ঠানাদি পরিদর্শনার্থে দেবদেবীদের আগমন হয়, ইত্যাদি। ভারত ও আশপাশের অন্যান্য দেশের প্রতিমাপূজকেরা কার্তিক মাসে খোলা আকাশে প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব করে থাকে। এসব আচার ধীরে ধীরে বড়দিন উদ্যাপনে যুক্ত হয়ে গেল। যেমন সাধু নিকোলাসের বিষয়টি বড়দিন উদ্যাপনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, যার পর্ব দিন ৬ ডিসেম্বর। একটি সময় ছিল যখন সাধু নিকোলাসের পর্বদিনে শিশুদের উপহার দেওয়া হতো। আজকের দিনে জগতের কিছু কিছু অ-খ্রীষ্টিয় আচার-অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আরো সব রীতিনীতি বড়দিনের উৎসবকে ঘিরে গ্রহণ করা হয়েছে অর্থাৎ সংস্কৃত্যায়ন করা হয়েছে।

ক্রীসমাস ট্রি সমাচার

পৃথিবীর বহু সমাজেই বৃক্ষপূজার প্রচলন আছে। অশ্বত্থগাছকে বোধিবৃক্ষ হিসেবে পূজা করা হয় বৌদ্ধধর্মে। হিন্দুধর্মে বট-অশ্বত্থ জাতীয় বনস্পতি পূজা পেয়ে আসছে বহু হাজার বছর ধরে। ইউরোপে যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও অনেক অনেক দিন আগে থেকে পাইন, ফার ইত্যাদি চিরসবুজ বৃক্ষের কদর ছিল। এসব গাছের ডালপালা ইয়োরোপীয়রা তাদের ঘরের দরজা-জানালায় ঝুলিয়ে রাখত। এই প্রথাটির পেছনে যে লোকবিশ্বাসটি কাজ করত সেটি হচ্ছে এই যে চিরসবুজ গাছের ডালা কোনো ঘরের দরজায় আর জানালায় ঝোলানো থাকলে ভূত-প্রেত-মন্দ আত্মা-রোগশোক কোনোমতেই আর সে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।

উত্তর গোলার্ধে বছরের সবচেয়ে ছোট দিন আর সবচেয়ে বড় রাত হচ্ছে ২১ বা ২২ ডিসেম্বর। সূর্য এই দিনে নিরক্ষরেখা থেকে দূরতম বিন্দুতে অবস্থান করে। এরকম দুটি দূরতম বিন্দু বা ‘সলসটিস’ কল্পনা করা হয় সূর্যের অবস্থানের: উত্তরায়ণ বা কর্কটক্রান্তি (২১ জুন) আর দক্ষিণায়ণ বা মকরক্রান্তি (২১ বা ২২ ডিসেম্বর)। উত্তরায়নের পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই সূর্যের তাপ কমে যায় এবং শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকে। প্রাচীনকালে মানুষ যেহেতু সূর্যকে দেবতা মনে করত সেহেতু তারা ভাবত কর্কটক্রান্তির পর থেকে সূর্যদেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুতরাং উত্তরায়নের দিন সূর্যদেবের আরোগ্য কামনা করে তারা চিরসবুজ বৃক্ষের ডাল বা পাতা ঝোলাত ঘরের দরজায়। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, অচিরেই গাছে গাছে আবার নতুন পাতা গজাবে ঠিক সেসব দিনের মতো যখন সূর্যদেব সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। চিরসবুজ বৃক্ষের ডাল বা পাতা তাদের স্বরণ করিয়ে দিতে যে সূর্যদেবের এই অসুস্থতা চিরস্থায়ী কিছু নয়। কিছুদিন পরেই তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং গ্রীষ্মকালও আবার ফিরে আসবে।

শুধু ইউরোপে নয়, প্রাচীন মিশরীয়রাও ভাবত, উত্তরায়ণের দিন তাদের সূর্যদেবতা ‘রা’ (যার মাথা বাজপাখির মতো আর মাথার পেছনে থাকে একটি উজ্জ্বল চাকতি) অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মিশরীয়দের চিরহরিৎ বৃক্ষ ছিল না। সূর্যদেবের আরোগ্য কামনায় প্রাচীন মিশরীয়রা সবুজ ডালপালা  (খেজুরপাতা বা নলখাগড়া-প্যাপিরস) দিয়ে সাজাত তাদের বাড়িঘর। 

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দক্ষিণায়নের দিন ‘স্যাটারনালিয়া’ নামে একটি উৎসব করতো। স্যাটারনালিয়া উৎসবে সবুজ ডালপালা দিয়ে ঘরবাড়ি সাজাত রোমানরা। এই উৎসব হতো শনিদেবতার সম্মানে। শনি ছিল রোমানদের কাছে কৃষিকাজের দেবতা। রোমানরা জানত, দক্ষিণায়নের কিছুদিন পর থেকেই চারদিকে আবার সবুজে ভরে উঠবে এবং খামারগুলোতে ফসল ফলতে শুরু করবে। স্যাটারনালিয়ার দিনটিকে রোমানরা খুবই পবিত্র বলে মনে করতো। এই দিন যুদ্ধ ঘোষণা করা যেত না, প্রভু আর দাস একাসনে বসে আহার করতে পারতো, পারস্পারিক স্নেহ-বন্ধুত্ব-ভ্রার্তৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ উপহার-বিনিময়েরও প্রচলন ছিল। শহুরে রোমান আর গ্রামবাসী রোমানদের ধর্মাচরণে অবশ্য কিছু পার্থক্য ছিল। গ্রামবাসী ব্রাত্য রোমানদের ধর্মে ‘বাচ্চু’ (বা ‘বুচ্চু’-সংস্কৃত ‘বৎস’। ছিল উর্বরতার দেবতা। গ্রামবাসী রোমানরা ধাতুর ছোট ছোট টুকরা, বাচ্চু দেবতার মূর্তি ইত্যাদি চিরহরিৎ বৃক্ষে ঝুলিয়ে দিত। সূর্য-দেবতার সম্মানে বারটি মোমবাতি আটকে দিতো তারা এই গাছে।

উত্তর ইউরোপে ফরাসিদের পূর্বপুরুষ গলোয়ারাও এইদিনে চিরসবুজ গাছের ডালপালা দিয়ে তাদের মন্দির সাজাতো। গলোয়াদের ধর্মে এসব বৃক্ষ ছিল তাদের দেবতা ওয়ডেনের সাথে সম্পর্কিত। এই ওয়ডেন দেবতার নাম এখনও বেঁচে আছে সপ্তাহের একটি দিন ‘ওয়েডনেসডে’ বা বুধবারের মধ্যে। গলোয়ারা নানারকম ফলও ঝোলাত এই বৃক্ষে। গলোয়াদের কাছে চিরহরিৎ বৃক্ষ ছিল চিরন্তন জীবনের প্রতীক।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো চিরসবুজ বৃক্ষগুলো সূর্যদেবতা ‘বালডের’-এর বিশেষ প্রিয়পাত্র। এ বিশ্বাস ইউরোপের অন্যত্রও ছিল। এর কারণ সব গাছপালা-ঝোপঝাড় যখন মরে যায় যায়, তখন চিরহরিৎ বৃক্ষ, যেমন পাইন বা ফারগাছ সবুজ থাকে কী করে? নিশ্চয়ই এসব গাছের কোনো জাদুকারী বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। অনেক ঐতিহাসিক (ভাষাবিজ্ঞানী) মনে করেন, খ্রিসমাসের প্রাচীন নাম ‘ইউল’ শব্দটি এসেছে প্রাচীন নর্স শব্দ ‘রোল’ থেকে যার অর্থ ‘চক্র’। চক্র বা চাকা সূর্যের প্রতীক।

খ্রিসমাস ট্রির নামে দুটি আলাদা প্রথা চালু ছিল: ১. ইউল লগ আর ২. খ্রিসমাস ট্রি। প্রথমটি অনেক দিন হলো উঠে গেছে, দ্বিতীয়টি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এখনকার দিনে লোকজন বাজার বা সুপার মার্কেট থেকে খ্রিসমাস ট্রি কিনে আনে। এই প্রথাটি অনেক পুরনো একটি প্রথাকে মনে করিয়ে দেয়। প্রাচীন ইংল্যান্ডে খ্রিসমাসের আগের সন্ধ্যায় বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবাই বনে গিয়ে মোটাসোটা একটি গাছ কাটত। এরপর গাছের কাণ্ডে দড়ি বেঁধে সাবই মিলে টেনেহিঁচড়ে কাণ্ডটিকে বাড়ি নিয়ে আসত। কাণ্ডটির নাম ‘ইউল লগ’। এরপর গাছের কা-টির স্থান হতো পারিবারিক অগ্নিকুণ্ড বা ফায়ারপ্লেসে। খ্রিসমাসের পর বারদিন ধরে এই ‘ইউল লগ’ জ্বলত বাড়িতে বাড়িতে। ইউল লগে আগুন দেবারও নির্দিষ্ট নিয়মকানুন ছিল; ১. প্রথমবার আগুন দেবার সঙ্গে সঙ্গে ইউল লগ জ¦লে উঠা চাই; ২. আগের বছরের আগুনে পোড়া একটি কাঠি দিয়ে এই আগুন জ্বালাতে হবে (যদি তা না করা হয় তবে বাড়িঘর আগুনে পুড়ে ছাই হবে!); ৩. ইউল লগের পোড়া কয়লা বিছানার নিচে রাখতে হবে (যদি তা না করা হয় তবে বাড়িতে বজ্রপাত হবে!)। ইউল-পূজার নিয়মকানুন হিন্দুদের অগ্নিপূজার কথা মনে করিয়ে দেয়।

এই প্রথা প্রচলিত ছিল সারা ইউরোপে। আয়ারল্যান্ডে ইউল লগের নামকরণ হয় খ্রিসমাস ব্লগ (এই ব্লগ থেকে হিসাব লেখার মোটা খেরোপাতা ‘ব্লগ’ যা থেকে ইন্টারনেটের ‘ব্লগ’ বা ব্লগার’)। স্পেনে খ্রিসমাট ব্লগটি যখন বন থেকে কেটে নিয়ে আসা হতো রাস্তা দিয়ে তখন ছেলেছোকরারা এর উপর লাঠি দিয়ে জোরে পেটাত যাতে করে মন্দ আত্মারা দূরে সরে যায়। এই কাজের পুরস্কার হিসেবে রাস্তার দুইপাশের বাড়িগুলো থেকে বাদাম, চকলেট ইত্যাদি উপহার দেয়া হত ছেলেমেয়েদের। ইউরোপের বলকান এলাকায় মহিলারা আগুন ফেলার আগে সিল্ক, সোনার তার, সুচ, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজাত খ্রিসমাস ব্লকটিকে।

এখন কেউ আর ফায়ারপ্লেসে খ্রিসমাস ব্লক পোড়ায় না। কিন্তু এই প্রথাটির ছায়া এখনও রয়ে গেছে অন্য একটি ফরাসি প্রথায়। ফরাসি পরিবারে ক্রিসমাসের দিন ‘ব্যুশ দ্য নোয়েল’ (ফরাসি ‘ব্যুশ’ কথাটির অর্থ ‘জ¦ালানী-কাঠ’) বা ‘খ্রিসমাস লগ’ নামে একটি চকোলেট কেক খাবার প্রথা আছে। কাঠের গুড়ির আকৃতির বাদামি রঙের এই কেকটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা আনন্দ করে খায়। এই কেকে উপর পবিত্র সুচ, ব্যাঙের ছাতা ইত্যাদির ক্রিমের রেপ্লিকা লাগানো থাকে ঠিক যেমনটি থাকতো বন থেকে কেটে নিয়ে আসা ইউল লগে।

দেখাই যাচ্ছে, খ্রিস্টপূর্বযুগের লৌকিক ধর্মের অঙ্গ এই কাঠ-পোড়ানোর প্রথা পরে খ্রিস্টধর্মের অঙ্গীভূত হয়। প্রথাটি যে খুবই প্রাচীন তার প্রমাণ এই যে ওল্ড টেস্টামেন্টে এই প্রথার উল্লেখ আছে। যিহূদি নবি যিরমিয় এমনই বলেছেন যে ‘জনগণের এইসব প্রথার কোনো মাথামুণ্ডু । এসব প্রথা মানুষকে স্বর্গের পথে নিয়ে যায় না। এরা বনে গিয়ে কুড়াল দিয়ে গাছ কেটে আনে। এরপর সেই গাছের গুড়িটাকে এরা স্বর্ণ আর রৌপ্য দিয়ে সাজায়। এর উপর হাতুড়ি দিয়ে পেরেক মারে যাতে এটা না নড়াতে পারে . . ’।

ইউল লগের কাহিনি এখানেই শেষ। ফিরে আসি তবে খ্রিসমাস ট্রির কাহিনিতে। খ্রিসমাস ট্রির উল্লেখ আছে সপ্তম বা অষ্টম শতকের সেন্ট বোনিফেস প্রথায়। সেন্ট বোনিফেস এমন কিছু প্যাগান বা ব্রাত্য লোককে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন যাদের কাছে ওক ছিল অত্যন্ত পবিত্র একটি বৃক্ষ। সেন্ট বোসিফেস একটি ওক গাছ কেটে নামান দীক্ষিত এই প্যাগানদের সামনে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে কাটার সাথে সাথে ওক গাছটি চার ভাগে বিভক্ত হয়ে ফেটে যায়। ফাটা ওকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে চিরহরিৎ একটি গাছ। এটি সম্ভবত একটি রূপক কাহিনি। এর অর্থ হচ্ছে, এখন থেকে প্যাগান ধর্মের অবসান হলো এবং খ্রিস্টধর্ম চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো। দশম-একাদশ শতকে মধ্য ইউরোপে খ্রিসমাস পালনকালে এই গাছকে ঘরের সিলিঙ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হত উল্টো করে, শিকড় থাকত উপরের দিকে আর গাছের অগ্রভাগ থাকত নিচে মেঝের দিকে।

বড়দিনের সময় মানুষ যেন আনন্দভোগ ছাড়া আর কিছুই জানে না। উৎসবটির ধর্মীয় দিক হয়ে থাকে প্রায় নিতান্তই গৌণ। বড়দিন যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন, উৎসবের এই-ই উপলক্ষ্য। এতে ধর্মের ভেতরকার শুদ্ধভাব নেই, প্রার্থনা নেই, আছে হুজগ আর লঘুভাব। কিন্তু এর সূচনা ঠিক যীশু খ্রীষ্টের জীবনকালে ঘটেনি, এমনকি, তাঁর মৃত্যুর পরও প্রায় চার শতকেও নয়। কালক্রমে বড়দিনের সাথে যুক্ত হয় আনন্দভোগের উপকরণ, নৃত্যগীত, নতুন জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া উপহার বিনিময়, আলোকতরু ইত্যাদি। এ উপলক্ষে ছেলেমেয়েরা নাচে গায়, এই আর কি।

বড়দিন আশীর্বাদিত হোক

আমরা বড়দিনের সময়ে সামাজিক প্রতিটি আনন্দদায়ক আমোদ উপভোগ করা প্রত্যাখ্যান করছি না। কিন্তু ঈশ্বরের লোকদের, মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি, দর্শন, জগতের তত্ত্ব যা খ্রীষ্টের অনুরূপ নয়, সেই সম্পর্কে কলসীয় ২:৮ পদটি সতর্ক করে। বড়দিন একটি সামাজিক আমোদের ছুটির দিন হতে পারে আর এ বিষয়ে কোনো ভুল থাকে না। আমি দেখছি খ্রীষ্টের আশ্চর্যজনক জন্ম স্মরণ করায় কোনো ভুল নেই, যদি কেবল জোড়ালোভাবে তাঁর জন্মে নয় কিন্তু তাঁর মৃত্যু, সমাধি, এবং তাঁর পুনরুত্থানের বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে।

আমরা “বড়দিনে খ্রীষ্টকে” রাখতে পারি না। কারণ তিনি কখনোই বড়দিনে ছিলেন না! বাইবেলের শিক্ষানুযায়ী বড়দিন সম্পর্কে কিছুই করার নেই। বড়দিন খ্রীষ্টের দিন নয়। সপ্তাহের প্রথম দিন হলো প্রভুর দিন, দিনটি তাঁর পুনরুত্থানের আর ঈশ্বর কেবল এই একটি বিশেষ দিন খ্রীষ্টিয়ানদের দিয়েছেন। খ্রীষ্ট ধর্মের উপাসনা বর্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যীশুর পুনরুত্থান। আমরা খ্রীষ্টের পুনরুত্থানকে সম্মান করি, কিন্তু তাঁর জন্মদিনকে নয়।

মূল কথা হলো যে বড়দিন হলো একটি কাথলিক পৌরাণিক কাহিনী। আমরা জানি যে খ্রীষ্ট ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন নাই। কারণ ইতিহাস এমনকি বাইবেলের নতুন নিয়মও এই দিনটি সম্বন্ধে একমত নয়। ‘মকর ক্রান্তির দক্ষিণে অবস্থানের কাল সূর্যের জন্মদিন হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল এবং রোম ২৫ ডিসেম্বর সূর্যদেবের জন্ম তিথি উপলক্ষে পৌত্তলিক উৎসব পালিত হতো। চার্চ এই জনপ্রিয় প্রচলিত আনন্দ করতে ব্যর্থ হয়ে একে আধ্যাত্মিকভাবে অভিষেক দিয়ে ন্যায়পরায়ণ সূর্যদেবের উৎসব পালন করতে শুরু করে’ (চেম্বার এনসাইক্লোপিডিয়া) ‘রোমান কাথলিক এবং অধিকাংশ প্রোটেস্টান্ট ২৫ ডিসেম্বর উদযাপন করে। ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চ ৬ জানুয়ারি উদযাপন করে। ৩০০ খ্রীস্টাব্দের আগে ২৫ ডিসেম্বর উদযাপনের কোনো নজির নেই’ (বাইবেল এসনাইক্লোপিডিয়া, ১৯৮৩, ৩৩৮ পৃষ্ঠা)

যাহোক, বাইবেলে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে ঈশ্বর চান যেন আমরা তাঁর জন্ম একটি বিশেষ পর্বোৎসবে উদ্যাপন করি। ঈশ্বর যদি চাইতেন, তিনি আমাদের বলতেন, কবে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন আর সেদিনে আমাদের কী করা উচিত। বাইবেলের নতুন নিয়মের কোনো মণ্ডলীতে এর কোনো ব্যবহার নেই। প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান যীশুর জন্ম সম্বন্ধে অন্য কোনো পৌরাণিক কাহিনী, অলীক কোনো ধারণা বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে না, যা যীশুর জন্মের ঘটনাকে বিকৃত করে। খ্রীষ্টধর্মে ভ্রান্তি প্রবেশ করেছে আর এখনো সেই ভ্রান্তি বিদ্যমান।

প্রিয় বন্ধু, বড়দিনের সময় খ্রীষ্টেতে আপনার স্বাধীনতায় আনন্দ উপভোগ করুন। যদি আপনার কার্যকলাপ শাস্ত্র নিন্দা না করে আর প্রভুর সম্মুখে (রোমীয় ১৪ অধ্যায়) আপনার ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা যদি থাকে, আপনি নিজেই নিজে আনন্দ উপভোগ করতে স্বাধীন। পরক্ষণে “বৎসেরা, তোমরা প্রতিমাগণ হইতে আপনাদিগকে রক্ষা কর” (১যোহন ৫:২১ পদ)।

Comments

Popular posts from this blog

উপবাস - বাইবেলের আলোকে উপবাস

প্রতিমা পূজা এমনকি মূর্তি সম্পর্কে বাইবেল কী বলে? What does the Bible says about idolatry or even image?

ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করেছেন?