“খ্রীষ্টের জন্য স্থান নেই”

“ . . . পান্থশালায় তাঁহাদের জন্য স্থান ছিল না”  লুক ২:৭ পদ।

আনুমানিক দুই হাজার বৎসর আগের ঘটনা। মরিয়ম নামে যিহুদী একজন কুমারী কোনো পুরুষের সঙ্গে সহবাস না করেও গর্ভবতী হয়েছিলেন। যদিও যোষেফের সঙ্গে মরিয়মের বাগ্দান হয়েছিল। মরিয়ম ঈশ্বর থেকে এবং পবিত্র আত্মার শক্তিতেই গর্ভবতী হয়েছিলেন। 

সেই সময়ে সম্রাট আগস্ত কৈসর পৃথিবীর সমস্ত লোকদের নাম লেখাবার আদেশ দিলেন। সিরিয়ার শাসনকর্তা কুরীণিয়ের সময় এই প্রথমবার লোকগণনার জন্য নাম লিখবার ব্যবস্থা করেন। যোষেফ ছিলেন রাজা দায়ুদের বংশের লোক। রাজা দায়ুদের জন্মস্থান ছিল যিহুদিয়া প্রদেশের বৈৎলেহম গ্রামে। তাই যোষেফ নাম লিখবার জন্য গালীল প্রদেশের নাসারত গ্রাম থেকে বৈৎলেহম গ্রামে গেলেন। গর্ভবতী মরিয়মও গাধার পিঠে করে তাঁর সঙ্গেই সেখানে গেলেন। বৈৎলেহমে যোষেফের নিজের বাড়ী না থাকায় তারা আশা করেছিল কোনো একটি হোটেলে একটি রুম ভাড়া করবে। এমন সময়ে মরিয়মের সন্তান জন্মের সময় হয়ে এলো, যোষেফ তার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেন কোনো অবস্থায় একটি হোটেলে তিনি একটি রুম পেতে পারেন। তাদের এ অবস্থায় আশ্রয়ের জন্য কোনো স্থান পাওয়া গেল না। 
একটি কথা বলা প্রয়োজন যে যোষেফ কিন্তু খুবই চিন্তিত ছিলেন একটি কারণে যে মরিয়ম গর্ভবতী। যোষেফ নিশ্চিত ছিলেন যে মরিয়মের এই গর্ভ হওয়াটা তার দ্বারা হয়নি, এমনকি অন্য কোনো পুরুষের দ্বারাও হয়নি, তবুও গর্ভবতী মরিয়ম আশা করে আছে যে যোষেফ তাকে বিয়ে করবে, আর যোষেফেরও সে রকম ইচ্ছা। যোষেফের বিশ্বাস ছিল মরিয়ম একজন ঈশ্বর ভক্ত ধার্মিক কুমারী কন্যা, কিন্তু মরিয়মের এই গর্ভ হওয়ার কারণে যোষেফ হঠাৎ নয় কিন্তু গোপনে তাকে ছেড়ে চলে যাবেন বলে মনে মনে ঠিক করতে ছিলেন, কারণ তিনি চাইলেন না যেন মরিয়ম কুমারীরূপে অর্থাৎ বিয়ে না করে গর্ভবতী হওয়ায় লোকের সামনে লজ্জায় পডুক বা চরিত্রহীনতার দোষে তাকে কেউ পাথর মারুক। কিন্তু প্রভুর এক দূত স্বপ্নে যোষেফকে দেখা দিয়ে বললেন মথি ১:২০,২১ “যোষেফ, দায়ূদ-সন্তান, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করিতে ভয় করিও না, কেননা তাঁহার গর্ভে যাহা জন্মিয়াছে তাহা পবিত্র আত্মা হইতে হইয়াছে; আর তিনি পুত্র প্রসব করিবেন, এবং তুমি তাঁহার নাম যীশু রাখিবে; কারণ তিনিই আপন প্রজাদিগকে তাহাদের পাপ হইতে মুক্তি দিবেন।” তার চোখের সামনেই পুরাতন নিয়মের সেই ভাববানী পূর্ণ হতে চলছে।

বাইবেলে উল্লেখ আছে যে এক কুমারী শিশু পুত্রের জন্ম দেবে তার নাম হবে ইম্মানুয়েল। যিশাইয় ৭:১৪ “দেখ, এক কুমারী গর্ভবতী হইয়া প্রসব করিবে, ও তাহার নাম ইম্মানুয়েল (আমাদের সহিত ঈশ্বর) রাখিবে।” আরো নিশ্চিত হওয়া যায় মথি ১:২৩ “দেখ সেই কন্যা গর্ভবতী হইবে, এবং পুত্র প্রসব করিবে, আর তাহার নাম রাখা যাইবে ইম্মানুয়েল” 

পরে যোষেফ মরিয়মকে ভালোবেসে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং একজন ভালো স্বামীর কর্তব্য পালনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, কিন্তু তিনি অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন যখন মরিয়মের জন্য একটু ভালো জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না যেখানে মরিয়ম একটি শিশুর জন্ম দিতে পারে এই পৃথিবীতে। কোনো হোটেলে তাদের থাকার জন্য একটু স্থান পাওয়া যায়নি, কিন্তু পেয়েছিল বাইরে এক আস্তাবলে যেখানে . . সেই রাজার রাজা, . .প্রভুর প্রভু, . .সেই সৃষ্টি কর্তা, . ..সেই বিচার কর্তা . . পাপীদের একমাত্র আশা . . সেই পাপ ক্ষমাকারী ঘোষণা দিয়ে এই পৃথিবীতে প্রবেশ করেছিলেন। 

তাঁর জন্ম হয়েছিল গন্ধময় এক নিম্ন পশুর আস্তাবলে।

বাইবেলের অন্য সব বিখ্যাত ভাববানী ঘটে যাওয়া ও পূর্ণ হওয়ার মধ্যে এই ভাববানী হুবহু ও অবিকল ঠিক আক্ষরিকভাবে পূর্ণ হয়েছিল মুক্তিদাতা যীশুর জন্মের মাধ্যমে। 

মরিয়ম ও যোষেফের জন্য কি কারো কোনো স্থান ছিল না বরং এটাই জগতের এক পরিষ্কার ছবি যে যীশুর থাকার জন্য স্থান ছিল না। এ বিষয়ে এমন কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না যে হোটেলের মালিক অথবা কোনো বাড়ীর মালিক চায়নি যে তাদের দেওয়া আশ্রয়ে যীশুর জন্ম হোক, কিন্তু তারা এ বিষযে ছিল অজ্ঞ। যীশুর জন্ম ও তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য তারা জানত না। তারা ছিল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, নিজেদের ব্যবসা, পেশা, আনন্দ ফুর্তি নিয়ে ব্যস্ত। রোমীয় ৩:১১ পদে উল্লেখ আছে যে এমন কেউ নাই যে ঈশ্বরের বিষয় বুঝতে পারে ও ঈশ্বরের অন্বেষণ করে। সেই সময়ে ঈশ্বর খ্রীষ্টের প্রতি জগতের এই মনোভাবের স্পষ্ট ছবি তুলে ধরেছেন তাঁর বাক্যে। যীশু জানতেন যে মানুষ তাঁকে চাইবে না। যে মানুষ তাকে অগ্রাহ্য করবে, সেই মানুষই তাকে ঘৃণা করবে; কিন্তু এখনও তিনি আসেন স্নেহ প্রেম ভালোবাসা নিয়ে।

যদিও অনেকে বিভিন্নভাবে তাঁকে গ্রহণ করেছিল, যেমন মুক্তিদাতার জন্ম হওয়ার আনন্দের খবর স্বর্গদূতেরা মেষপালকদের জানালে তারা একে অন্যেকে বল্ল চলো আমরা বৈৎলেহমে যাই এবং যে ঘটনার কথা প্রভু আমাদের জানালেন তা গিয়ে দেখি। তারা গিয়ে যাবপাত্রে শোওয়ানো সেই শিশুটিকে খুঁজে বের করল আর স্বর্গদূতেরা মেষপালকদের কাছে যা বলেছিলেন তার সবকিছু সেই মতই দেখেশুনে তারা ঈশ্বরের প্রশংসা ও গৌরব করতে করতে ফিরে গেল। 

হান্না নামে একজন মহিলা ভাববাদিনী ছিলেন। তার অনেক বয়স হয়েছিল। উপাসনা-ঘর ছেড়ে তিনি কোথাও যেতেন না বরং উপবাস ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে দিন-রাত ঈশ্বরের উপাসনা করতেন। তিনি ঈশ্বরের ধন্যবাদ দিতেন আর ঈশ্বর যিরূশালেমকে মুক্ত করবেন বলে যারা অপেক্ষায় ছিল, তাদের কাছে সেই শিশু যীশুর কথা বলতেন। 

যিরূশালেমে শিমিয়োন নামে একজন ধার্মিক ও ঈশ্বর-ভক্ত লোক ছিলেন। ঈশ্বর কবে ইস্রায়েলীদের দুঃখ দূর করবেন সেই সময়ের তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। পবিত্র আত্মা তার উপর ছিলেন এবং তার কাছে প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি প্রভু খ্রীষ্টকে না দেখে মৃত্যু দেখবেন না। পবিত্র আত্মার দ্বারা চালিত হয়ে শিমিয়োন সেদিন যিহুদীদের উপাসনা ঘরে এলেন। মোশির আইন অনুযায়ী কাজ করার জন্য যোষেফ ও যীশুর মা যখন শিশু যীশুকে নিয়ে আসলেন তখন শিমিয়োন তাকে কোলে নিলেন। তারপর তিনি ঈশ্বরের গৌরব করে বললেন লুক ২:২৯-৩২ “প্রভু, এখন তোমার বাক্য অনুসারে তোমার দাসকে তুমি শান্তিতে বিদায় দিতেছ, কারণ আমার চক্ষু ‘তোমার পরিত্রাণ দেখিতে পাইল যাহা তুমি সকল জাতির সাক্ষাতে প্রস্তুত করিয়াছ’; ইহা সেই জ্যোতি, যাহা বিজাতিদের নিকটে সত্যপ্রকাশ করিবে’। আরো বললেন যে ঈশ্বর এটাই স্থির করেছেন যে, এই শিশুটির জন্য ইস্রায়েলীদের মধ্যে অনেকেই ঈশ্বরের কাছ থেকে পিছিয়ে যাবে, আবার অনেকেই ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে আসবে। 

পরবর্তীতে পূর্বদেশীয় পণ্ডিতেরা বহুদূর থেকে এসে যীশুকে তাঁর মা মরিয়মের কাছে দেখতে পেয়ে মাটিতে উবুর হয়ে সেই শিশু যীশুকে প্রণাম করে ঈশ্বরের সম্মান করলেন। আর তারা যীশুকে সোনা, সুগন্ধি-ধুপ ও গন্ধরস উপহার দিলেন। 

সখরিয় নামে একজন যাজক ছিলেন, তার স্ত্রীর নাম ছিল ইলীশাবেৎ, তারা দুজনেই ঈশ্বরের চোখে ধার্মিক ছিলেন, প্রভুর সমস্ত আদেশ ও নিয়ম তারা নিখুঁতভাবে পালন করতেন। মরিয়ম পবিত্র আত্মায় গর্ভবতী হওয়ায় তিনি ইলীশাবেৎকে সুসংবাদটি জানালেন আর ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইলীশাবেৎও বৃদ্ধা বয়সে সেই সময়ে গর্ভবতী ছিলেন, মরিয়মের গর্ভে মুক্তিদাতার জন্ম হবে শুনে তিনি পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হয়ে জোরে জোরে বললেন “নারীদের মধ্যে তুমি ধন্য, তোমার গর্ভের ফলও ধন্য। আমার এমন সৌভাগ্য কেমন করিয়া হইল যে, আমার প্রভুর মাতা আমার নিকটে আসেন” লূক ১:৪২,৪৩ পদ। ইলীশাবেৎও বাপ্তিস্মদাতা যোহনের জন্ম দিয়েছিলেন। সখরিয়ও ঈশ্বরের ধন্যবাদ দিয়ে তার সন্তানের উদ্দেশ্যে বলেছিল যে তার সন্তান যোহন বাপ্তাইজককে মহান ঈশ্বরের ভাববাদী বলা হবে, কারণ সে প্রভু যীশুর পথ ঠিক করার জন্য তার আগে আগে চলবে। সে যীশুর লোকদের জানাবে কীভাবে আমাদের ঈশ্বরের দয়ার দরুন পাপের ক্ষমা পেয়ে পাপ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। যীশুর দয়াতে স্বর্গ থেকে এক উদিত সূর্য আমাদের উপর নেমে আসবেন, আর যারা অন্ধকারে ও মৃত্যুর ছায়ায় বসে আছে, তাদের আলো দেবেন, ইত্যাদি। 

যদিও অনেকে যীশুকে এভাবে স্বীকার করেছিল আর গ্রহণও করেছিল, কিন্তু অন্যান্য অনেকেই তাকে প্রত্যাখান করেছে। অনেকের কাছেই খ্রীষ্টের স্থান ছিল না।

যীশুর জগতে অলৌকিক কার্যের জন্য কিছু করগ্রাহী, বেশ্যা, আরো অনেকে তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল, এমনকি তিনি পাঁচ হাজার লোককে খাবার দেবার সময়ও। কিন্তু এর সবছিুই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর প্রতি অগ্রাহ্য ও উপেক্ষার মাঝে, ক্রোধ উত্তেজনা, বিদ্বেষ শত্রুতা ও জনসাধারণের তাঁকে ঘৃণার মাঝেও। এসবকিছু কোনো রাজনৈতিকতায় নয়, কিন্তু ধর্মের চালচলনে আর বিভিন্ন আচার-ব্যবহারের ভীড়ে। তারা প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে ঘৃণা করত কারণ তিনি তাদের বিভিন্ন ধর্ম ব্যবস্থা, মানুষের প্রথা, আচার-আচরণের শিক্ষা ও কুপথে থেকে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার যে চেষ্টা করত সে সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি শিক্ষা দিতেন।

জগতে কখনই তাঁর জন্য স্থান ছিল না। শিশু যীশুর জন্য পান্থশালায়ও স্থান ছিল না, স্থায়ী বসবাসের জন্যও তাঁর কোনো জায়গা ছিল না। মথি ৮:২০ “শৃগালদের গর্ত আছে, এবং আকাশের পক্ষীগনের বাসা আছে; কিন্তু মনুষ্যপুত্রের মস্তক রাখিবার স্থান নাই।” 

ঈশ্বরের পুত্রকে স্থান দেওয়া হয়নি সিন্যাগগে (যিহুদীদের ধর্মীয় সমাজ-গৃহ), এমনকি তাঁর নিজের দেশ গালীল প্রদেশে নাসরত গ্রামেও তাঁকে স্থান দেওয়া হয় নাই। তারা যীশুকে ঘৃণা করেছে এমনকি তারা যীশুকে হত্যা করতেও চেয়েছে। 
তাঁর স্থান ছিল না তার মা ও ভাইদের ঘরে। তার ভাইয়েরা তাঁকে তাদের দেশ ছেড়ে যিহুদিয়ায় চলে যেতে বলেছে, তাঁর কোনো ভাই-ই তাঁকে বিশ্বাস করেনি যে তিনি পরিত্রাণকর্তা (যোহন ৭:৩-৫)। 

তাঁকে স্থান দেওয়া হয়নি গাদারীয়দের দেশে। মথি ৮:৩৪ “নগরের সমস্ত লোক যীশুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বাহির হইয়া আসিল, আর তাঁহাকে দেখিয়া আপনাদের সীমা হইতে চলিয়া যাইতে বিনিত করিল” 

যিরূশালেমেও তাকে স্থান দেওয়া হয়নি। যোহন ৮:৫৯ “তখন তাহারা তাঁহার উপর ছুঁড়িয়া মারিতে পাথর তুলিয়া লইল, কিন্তু যীশু নিজেকে গোপন করিলেন, আর সেই মন্দিরের বাহিরে গেলেন”  

তাঁর কোনো স্থান ছিল না এই পৃথিবীতে, হেরোদ, পন্তীয় পীলাত, প্রধান যাজক, অধ্যাপক, ফরীশী, সদ্দুকী, সাধারণ জনগণ আর রোমান সৈন্যরাও সমবেতভাবে যীশুর মৃত্যু চেয়েছিল। আর এ কারণেই যীশুর স্থান ছিল না তাদের কাছে। 

যেখানে প্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই বৈৎলেহমেও তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। 

পণ্ডিতেরা যীশুকে যিহুদীদের রাজা বলায় হেরোদ রাজা হিংসায় শিশু যীশুকে হত্যা করতে চেয়েছিল। শিশু যীশুকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল তার মা ও যোষেফের সঙ্গে বিদেশে। তাঁর জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হয়েছে সেই মিসর দেশে। বৈৎলেহমে তাঁর স্থান হয়নি। 

যীশুর নিজ গ্রাম নাসরত যেখানে তিনি ছোটবেলা থেকে তিরিশটি বৎসর কাটিয়েছেন সেই নাসরতীয়রা তাঁর জ্ঞান ও পরাক্রমকার্যের জন্য ঈর্ষা করে “এ কি সূত্রধরের (মিস্ত্রীর) পুত্র নয়?” বলে তাঁকে তুচ্ছ ও অপমান করেছিল। 

ফরীশীরা যারা গোড়া যিহূদী, এরা মোশীর আইন-কানুন এবং ধর্মের আরও অনেক নিয়মের বাইরের দিকটা খুব যত্নের সঙ্গে মেনে চলত। কিন্তু বেশীর ভাগ ফরীশীরা ছিল অহংকারী ও ভণ্ড। তারা যীশুকে তার শক্তি ও ক্ষমতার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে বলেছিল “এ ব্যক্তি আর কিছুতে নয়, কেবল ভূতগণের অধিপতি বেল্সবূলের (শয়তান বা ভূতের অধিপতি) দ্বারাই ভূত ছাড়ায়।” তারা যীশুকে প্রবঞ্চক বলেও আখ্যা দিয়েছিল। 

যীশু নিজেকে বিশ্রামবারের কর্তা বলাতে প্রধান যাজক তাঁর প্রতি ঈর্ষা করেছিল। 

যীশু যখন আহার করেন তখন লোকে তাঁকে “ঐ দেখ, এক জন পেটুক ও মদ্যপায়ী” বলে বদনাম করে তাঁকে অপমান করেছিল। 

যীশু যখন শিশুদের মাথার উপর হাত রেখে প্রার্থনা করেন তখনও তাঁর সামনে শিশুদের ভর্ৎসনা করা হয়, আর এভাবে যীশুকে অসম্মান করা হয়, তাঁর মনে কষ্ট দেওয়া হয়। তাঁর শিষ্যরাও এক ঘন্টার জন্য জেগে থাকতে পারেনি সেই গেৎশিমানী বাগানে, যখন যীশু প্রার্থনা করতেছিলেন। আর সেই সময়ই তাঁর এক শিষ্য অনেক লোকজনের সঙ্গে মশাল, ছোরা, লাঠি নিয়ে আর সেই বিশ্বাসঘাতক চুম্বন দিয়ে আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর বিচার করা জন্য আর মেরে ফেলার জন্য। 

এমনকি তাঁর মৃত্যুর সময়ও যীশুকে স্থান দেওয়া হয়নি। তাঁর উলঙ্গতাকে উপেক্ষা করে প্রভু যীশুর শেষ লজ্জা নিবারনের কাপড়ও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাকে উলঙ্গমত চাবুক মারার জন্য। 

ঐ পাঁচ হাজার লোকেরা যারা যীশুকে রাজা করার জন্য ধরতে উদ্যত ছিল, যাদের তিনি অলৌকিক কার্যে পাঁচটি রুটি ও দুটি মাছ দিয়ে তাদের সকলের মুখে তুলে দিয়েছেলেন। খেয়ে উদরতৃপ্ত হয়েছিল সকলে, আর তারাই কিনা সেই মুখেই যীশুর উদ্দেশ্য চিৎকার করে বলে উঠল “উহাকে ক্রুশে দাও উহাকে ক্রুশে দাও”, তাঁর এই করুণবস্তায় তাদের অনেকেই তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে তাঁকে তামাশা করে বলল্ “যিহূদীরাজের জয়” “মারহাবা, ইহুদীদের বাদশাহ্” “যিহুদি-রাজ নমস্কার।” তাদের হৃদয়ে এই পাপীদের প্রভু মুক্তিদাতার কোনো স্থান ছিল না। 

যীশুকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল তাঁর পিপাসার সময়, যখন তিনি মৃত্যু-যন্ত্রণায় মধ্যে দিয়ে আপনার ও আমার পাপের ভার পরিশোধ করতে যাচ্ছেন। তিনি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কেঁদে উঠলেন আর বললেন “আমার পিপাসা পাইয়াছে” আর তাঁকেই কিনা পান করতে দেওয়া হয়েছিল জলের পরিবর্তে তিক্ত সিরকার রস। আর ঐ রস পান করার পর তিনি মাথা নত করে তাঁর প্রাণ সমর্পণ করলেন, এখানেও যীশুকে শীতল জল থেকে বঞ্চিত করা হলো। 

তাঁকে উপহাস করা হয়েছিল যখন তিনি জগতের পাপীদের জন্য ক্রুশে তাঁর ঝুলন্ত শরীরের মাধ্যমে তাঁর ভালোবাসার শেষ সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন, নিজ প্রাণ দিয়ে মানুষের পাপের প্রায়চিত্ত করলেন। 

তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়েছেন এই সত্যটা যেন কোনো প্রমাণে স্থান না পায় সেজন্য পুরোহিতেরা যীশুর কবরের পাহারাদার সৈন্যদের টাকা দিয়ে বললেন যে, তোমরা বলবে যে তোমরা যখন রাতে ঘুমাচ্ছিলে, তখন যীশুর শিষ্যরা এসে তাঁর দেহ চুরি করে নিয়েছে। মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছিল তাঁর পুনরুত্থানকেও, যেন যীশুর মৃত্যু থেকে পুনরায় জীবিত হওয়ার সত্য কথার কোনো স্থান না থাকে।

খ্রীষ্ট এই জগতের ছিলেন না। 
তিনি স্বর্গে গৌরব ও প্রশংসায় ছিলেন। 
খ্রীষ্ট স্বর্গের ঐরকম সেবা পেতে জগতে আসেননি। 
তিনি তাঁর পিতার দ্বারা সন্তানরূপে এই জগতে প্রেরিত হয়েছিলেন আর তিনি পবিত্র আত্মার দ্বারা নম্র ও শিষ্টতায় বৃদ্ধি পেতেছিলেন। 
যীশু খ্রীষ্ট মানুষের মুক্তির জন্য মুক্তির পথ দেখাতে তিনি স্বর্গে ঈশ্বরের কোল থেকে এই পাপময় দুষ্কর্মের জগতে পাপীদের কাছে সাধারণ মানুষের ঘরে জন্মেছিলেন। 
তিনি স্বর্গীয় জ্ঞানে ও পাণ্ডিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। 
তিনি পাপীদের জানিয়েছেন স্বর্গরাজ্যের কথা, পথ দেখিয়েছেন এক নতুন জীবন ও সমাজের। মানুষের কাছে তিনি পৌছে দিয়েছিলেন প্রেমের অমৃত বাণী। 
তিনি জগতের নিষ্ঠুরতা, জুলুম, নির্যাতনের বিপক্ষে অত্যন্ত বিনীতভাবে সত্যে ও ধার্মিকতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই জগতে ছিলেন। 
তিনি সবাইকে জানিয়েছিলেন তাঁকে অনুসরণ করার আমন্ত্রণ। 
তবুও তাঁকে গ্রহণ না করে সাধারণ অপরাধীর মতো দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। 
পাপীদের মুক্তিদাতারূপে জগতে তাঁকে স্থান দেওয়া হয়নি। 
তিনি জগতে থাকতে ব্যাকুল ও ছিন্নভিন্ন পালকবিহীন মানুষদের দেখে, অনেক পীড়িত নিরুপায় লোকদের দেখে, অনাহারে থাকা মানুষদের দেখে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলেন আর তিনি তাদের প্রতি করুণাবিষ্ট (মথি ৯:৩৬; ১৪:১৪; ১৫:৩২) হয়ে তিনি তাদের উত্তম পালক হলেন, সুস্থ করলেন, আহার দিলেন, ভালোবাসলেন সকলকে, কারণ তিনি ছিলেন দয়া-অনুগ্রহ ও সত্যে পূর্ণ। 
কিন্তু এরাও একদিন মুক্তিদাতার মুখের উপর চিৎকার করে বল্ল উহাকে ক্রুশে দাও, উহাকে ক্রুশে দাও। তাদের কাছেও শেষ পর্যন্ত খ্রীষ্টের সেই করুণার কোনো স্থান ছিল না। 
যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যু ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক ও অবমাননাকর, কিন্তু মৃত্যু তাকে গ্রাস করতে পারেনি, তিনি আবার বেঁচে উঠেছিলেন। 
তাঁকে ধরে রাখতে মৃত্যুর কোনো সাধ্য ছিল না। প্রভু যীশু খ্রীষ্ট জগতে থাকাকালীন তাকে বঞ্চিত করা হয়, মানুষ তাঁকে স্থান দেয়নি। 
খ্রীষ্ট মানুষের জ্যোতিস্বরুপ ছিলেন যেন সকলে সেই আলো দ্বারা নিজেদের অন্ধকারময় জীবন দেখতে পায়। কিন্তু মানুষ জ্যোতির চেয়ে অন্ধকার জীবন বেশী ভালোবাসল। 
তাদের কাছে ঐ জ্যোতির স্থান ছিল না।

খ্রীষ্ট যে প্রাণের মুক্তির কথা আমাদের বলেছেন তার স্থান আজ কোথায়? 

আজও সেই পরিত্রাতাকে তিরষ্কার করা হয়, অগ্রাহ্য করা হয় তার পরিত্রাণ কাজকে, অবজ্ঞা করা হয় তাঁর সেই নিরাময় শিক্ষাকে। 

তিনি এসেছিলেন হারানোদের অর্থাৎ ঈশ্বরের অবাধ্যতার কারণে দুরে থাকা মানুষের খোঁজে। 
খ্রীষ্ট এই হারানোদের ঈশ্বরের প্রতি মন-পরিবর্তন ও একমাত্র মুক্তির উপায় খ্রীষ্টকে বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। 

জগত আজ ধর্মকর্মে, শাস্ত্রীয়জ্ঞানে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে কিন্তু প্রশ্ন হলো এসবে খ্রীষ্টের স্থান কোথায়? 

আমরা যদি আমাদের হারানো অবস্থা বুঝতে না পারি তাহলে খ্রীষ্টের হারানোদের উদ্ধার কর্মের স্থান নেই। 
তিনি বলেছেন মন ফিরাও (মার্ক ১:১৫), তিনি বলেছেন স্বর্গে যেতে হলে নতুন জন্ম হওয়া প্রয়োজন, তিনি বুঝিয়েছেন যেন সকলে তাঁকে জেনে তাঁর উপর সম্পূর্ণ আস্থা ভরসা রাখি আর এভাবেই যেন তাঁর উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করি আর এই বিশ্বাসেই তাঁকে আমাদের হৃদয়ে এখন স্থান দিতে পারি। 

তিনি আজ সশরীরে নেই যে তাঁকে আমাদের ঘরের সোফায় বা মাদুরে বসতে স্থান দেই, কিন্তু তিনি বলেছেন - তিনি যা কিছু আমাদের জন্য বলে গেছেন তাতে যদি স্থির থাকি তাহলে আমরা তাঁর শিষ্য হই (যোহন ৮:৩১) কিন্তু কেউ যদি তাঁর কথা প্রত্যাখ্যান করে সে খ্রীষ্ট বিরোধী (মথি ১২:৩০)।

জগতে মুক্তিদাতার জন্য স্থান ছিল না ঠিক, কিন্তু আজকের দিনেও তাঁর স্থান নেই। 

আজ গড়ে অধিকাংশ মানুষেরই সম্পূর্ণভাবে যীশুর কোনো স্থান নাই, তাঁর প্রতি মন নেই, তাঁর প্রতি আগ্রহ নেই এমনকি তাঁর জন্য কোনো সময় পর্যন্ত নাই। 

আজ জগত মানুষের মতানুযায়ী, কাল্পনিক ২৫শে ডিসেম্বরকে প্রভু যীশুর জন্মদিন বলে সকলের এসময়ে বাড়তি উপার্জন থাকে বাড়তি ব্যয় করার জন্য। শুধুমাত্র রঙিন কাগজ, বেলুন দিয়ে ঘর-বাড়ি সাজিয়ে, ক্রিস্মাস-ট্রী, গোশালা ঘর বানিয়ে, মাংসিক অভিলাষে (ভোজন, পানে) মত্ত হয়ে মানুষের জাগতীক চিত্তবোধে যীশুকে একটু উপলব্ধী করার চেষ্ঠা করে, কিন্তু প্রশ্ন এসবে যীশুর স্থান কোথায়? 

আমাদের প্রভুতো মানুষের সেবা পেতে আসেননি। 
তিনি তো তাঁর চিরস্থায়ী বাক্যে তাঁর জন্মের কোনো তারিখ রেখে যাননি, নতুন নিয়মে উল্লেখ করা কোনো মণ্ডলীতে তো প্রভুর জন্ম পালিত হয়নি, 
খ্রীষ্টের শিক্ষা গ্রহণের চেয়ে কি তাঁর জন্মদিন পালন এতই গুরুত্বপূর্ণ? 

যদি আমাদের ঈশ্বর তাঁর জন্মদিন পালনের প্রয়োজন মনে করতেন তিনি তা উল্লেখ করতেন আমাদের পালনের জন্য। 

এ সব মানুষেরই মতলব আর তাই ঈশ্বরের বাক্যে স্পষ্টভাবে আমাদের জন্য মানুষের তত্ত্বজ্ঞান, অবাস্তব কথার বিষয়ে সাবধান করে বলেছেন যে “দেখিও দর্শনবিদ্যা ও অনর্থক প্রতারণা দ্বারা কেহ যেন তোমাদিগকে বন্দি করিয়া লইয়া না যায়; তাহা মনুষ্যদের পরম্পরাগত শিক্ষার অনুরূপ, জগতের অক্ষরমালার অনুরূপ, খ্রীষ্টের অনুরূপ নয়” (কলসীয় ২:৮; ইফিষীয় ৫:৬)। 

২৫শে ডিসেম্বর কখনও খ্র্রীষ্টের জন্মদিন নয় আর বাইবেলে তার কোনো প্রমাণও নেই। এই দিনকে খ্রীষ্টের জন্মের কাল্পনিক ধারণা করে আপনি কখনও খ্রীষ্টের জন্মের উদ্দেশ্যে খ্রীষ্টের দিন বলেও সাক্ষ্য বা প্রচার করতে পারেন না। এভাবে কাল্পনিক ধারণায় খ্রীষ্টকে কখনও স্থান দেওয়া যায় না। 

সত্যের উৎস আমরা কোথায় পাই? 
মানুষের মনগড়া কথায় না প্রভুর বাক্যে? 
আমরা কি মানুষের কথা শুনব না প্রভুর বাক্যকে স্থান দেব? 
জগৎ আজ মানুষের কথায় অনর্থক ঈশ্বরের আরাধনা করছে (মার্ক ৭:৭)। 
জগৎ আজ ঈশ্বরের আজ্ঞা ত্যাগ করে মানুষের কথায় ও মতে চলছে (মার্ক ৭:৮,৯)। 
আর এভাবেই মানুষের কথানুযায়ী ঈশ্বরের আরাধনা করাতে জগতবাসী ঈশ্বরের বাক্য অকার্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে (মার্ক ৭:১৩)। 
মানুষ আজ প্রভুর বাক্যে মন না দিয়ে বিভিন্ন প্রকার গুরুদের চমকপ্রদ কথায় কান দিয়ে সত্য থেকে দূরে সরে যায়। 
খ্রীষ্টের স্থান আর থাকে না। 
প্রভুর বাক্যে কোনো কিছু যোগ দেবার অধিকার তো আমাদের নেই, কিন্তু প্রভুর বাক্য খ্রীষ্টের আগমনকাল পর্যন্ত আমাদের নিষ্কলঙ্ক ও অনিন্দনীয় রাখতে বলেছেন (১তীমথিয় ৬:১৪)। 
প্রভুর বাক্যের সত্য ছাড়া অন্য রকম প্রচার কখনোই খ্রীষ্টের প্রচার নয় (গালাতীয় ১:৬-৯)

“আমরা সত্যের বিপক্ষে কিছুই করিতে পারি না, কেবল সত্যের সপক্ষে করিতে পারি” (২করিন্থীয় ১৩:৮)।

আজ জগতের অনেকেই বিশ্বাসে স্থান দিচ্ছে না যে খ্রীষ্ট পবিত্র আত্মায় কুমারী মাতার গর্ভে জন্মেছেন। 
আজ জগতের অনেকেই আস্থায়, ভরসায় স্থান দিচ্ছে না যে খ্রীষ্ট ক্রুশে হত হয়েছেন, 
আজ জগতের অনেকেই নির্ভয়ে স্থান দিচ্ছে না যে খ্রীষ্ট পুনরুত্থিত হয়েছেন। 
আজ জগতের অনেকেই খ্রীষ্টকে একমাত্র পথ, সত্য, জীবন বলে স্থান দিচ্ছে না।

একটি প্রশ্নের উত্তর আজ আমাদের জানা দরকার যে খ্রীষ্টের বিষয় নিজেরা যা বলি তা কি বিশ্বাস করি? 

আমাদের প্রভু আজও হৃদয় দ্বারে দাড়িয়ে আছেন, আঘাত করছেন, যেন সকলে তাঁর ডাক শুনে, হৃদয়ের দ্বার খুলে দেয়, তাঁকে অন্তরে স্থান দেয় (প্রকাশিত বাক্য ৩:২০)। প্রবেশ দরজা খোলার হাতল হৃদয়ের মধ্যে, আমি না খুলে দিলে তিনি প্রবেশ করতে পারছেন না। তিনি ঠিকিই সব জায়গায় আছেন কিন্তু প্রবেশ করার অধিকার তাঁর নাই। 

আজ আমরা ডিসেম্বর মাসে দাড়িয়ে প্রভুর একটি কথা স্মরণ করি . .
“তোমরা কেন হে প্রভু হে প্রভু বলিয়া ডাক, অথচ আমি যাহা বলি, তাহা কর না?” লূক ৬:৪৬ পদ।

নথনিয়েল হাজরা
সুভাষণ প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

Comments

Popular posts from this blog

উপবাস - বাইবেলের আলোকে উপবাস

প্রতিমা পূজা এমনকি মূর্তি সম্পর্কে বাইবেল কী বলে? What does the Bible says about idolatry or even image?

ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করেছেন?