মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্রুশে নির্যাতনে মৃত্যুর একটি চিত্র

ক্রুশ একটি লম্বা আর একটি ছোট কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে খাড়া ও আড়াআড়িভাবে জোড়া দিয়ে এটি তৈরি করা হতো। প্রাচীনকালে বিশেষতঃ রোমীয়রা - গুরুতর অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে দুই হাতের পাতায় ও দুই পায়ের পাতার উপর প্রেক দিয়ে ঐ ক্রুশের সঙ্গে বিদ্ধ করে মাটিতে খাড়া করে পুতে দিত। শাস্তিস্বরূপ এই যন্ত্রণা ছিল ভয়ঙ্কর, গুরুতর, আর ছিল অপরাধীর বেঁচে থাকার আকুল আকাঙ্ক্ষা । বাইবেল বলে যাকে ক্রুশে ঝোলান হয় সে অভিশাপগ্রস্ত আর প্রভু যীশু খ্রীষ্ট পাপীদের স্থলে অভিশপ্ত হয়েছেন (দ্বিতীয় বিবরণ ২১:২৩ পদ; গালাতীয় ৩:১৩ পদ)।
ডাঃ ট্রুম্যান ডেভিস্ একজন চিকিৎসক তার দৃষ্টিকোন থেকে ক্রুশেহত মৃত্যুর বিষয় একটি বর্ণনা দিয়েছেন : “ক্রুশটি মাটিতে রাখা হয় আর অপরাধের সেই ক্লান্ত ব্যক্তিটিকে তার কাঁধের পিছন থাকা শক্তিশালী কাষ্ঠের দিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সৈন্যবাহিনীরা তার হাতের কব্জির সম্মুখভাগ নিচু করতে ধরে রাখে। তারা একটি ভারী, চতুর্ধার, পেটা লোহার প্রেক দিয়ে কব্জির মধ্যে দিয়ে কাষ্ঠের সঙ্গে গভীরভাবে ঢুকিয়ে বিধে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্য হাতেও একই রকমভাবে কাজটি করে। তারা খেয়াল রাখে যেন হাত দুটি খুব একটা আঁটসাঁট অর্থাৎ টানটান না হয়, কিন্তু কিছুটা নোয়ান রাখে আর নড়াচড়ার অবস্থা করে দেয়। দু’টো পা প্রসারিত করে রাখে আর বাম পায়ের পাতার সঙ্গে ডান পায়ের পাতার সংস্পর্শে পিছনের দিকে কাষ্ঠের সঙ্গে চেপে ধরে। পায়ের আঙ্গুল নিচের দিকে টেনে পায়ের পাতা দুটোর উপরে মাঝখান দিয়ে খিলানের মতো করে একটি প্রেক বরাবর ঢুকিয়ে দেয়, হাঁটু নোয়ানোভাবে রাখা হয়। বলি দেবার জন্য লোকটি এখন ক্রুশরিত করা হলো। তার দেহসহ কাঠের ক্রুশটি উঁচু করে পায়ের নিচের কাষ্ঠের বাড়তি অংশ মাটিতে খাঁড়া করে পুতে রাখ হয়। প্রেক দিয়ে ফুঁটিয়ে দেওয়া তার হাতের পাতার উপর শরীরের সমস্ত ভার নিচের দিকে ঝুলতে থাকে, তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকে, আঙ্গুলগুলোর সম্মুখ বরাবর জলন্ত ব্যথা তীরবেগে বাহু দুটোর মাধ্যমে ছুটে যায় মস্তিকে আর ব্যক্তিটি বিকট চিৎকারে ফেটে পড়ে। হাতের তালুতে প্রেকের দ্বারা মধ্যবর্তী মাংশপেশীর উপর চাপ সৃষ্টি হয়। সে তার ছড়িয়ে পরা অসহনীয় যন্ত্রণা ত্যাগ করার জন্য তার নিজেকে উপরের দিকে বরাবর যেমন ঠেলতে থাকে, তেমনি তার দেহের সম্পূর্ণ ভার তার পায়ের পাতা বরাবর প্রেকের উপর গিয়ে পরে। প্রেকের দ্বারা ফুটো হওয়া ও দেহের চাপে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যাওয়ায় সে তার পায়ের হাড়ের মধ্যে থাকা মাংশপেশীতে আবারও দুঃসহ প্রচণ্ড যন্ত্রণা পায়। বাহু দুটো যেন ক্লান্ত হয়ে পরে, বিদ্ধ যন্ত্রণা দ্রুতবেগে দেহের মাংসের মধ্যে যায়, আর এর সবকিছুর মধ্যে পেশীতে গভীরভাবে গাঁট বা গিট বাঁধে, কিছুতেই আর তা কোমল থাকে না, ব্যথায় ধড়ফড়ানি হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায়। শরীরের এইসব যন্ত্রণায় তার নিজের প্রবল চেষ্টায় বুক ফুলিয়ে কমিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার ক্ষমতা তেমন আর থাকে না। বাতাস ফুসফুসে টেনে নিতে পারতে পারে কিন্তু নিঃশ্বাস বের করা খুবই কষ্ট হয়। এমনকি সে একটি ছোট শ্বাস তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। শেষমেষ ফুসফুসে কার্বডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, আর রক্তের শ্রোত বয়, দেহের মাংস আংশিকভাবে শান্ত হয়ে পরে। খেঁচুনিসহকারে সে নিজে আরেকটু শ্বাসত্যাগ করতে আর জীবনদায়ক অক্সিজেন নিতে জোর খাটায়। ঘন্টাখানেক অশেষ এই বেদনায়, দুমড়ে মোচড়ে পাক খায়, যন্ত্রণায় সবলে টেনে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে দেয় প্রেক বিদ্ধ কব্জি, মাঝে মাঝে থেমে যায় আংশিক শ্বাসরোধ। বিক্ষিপ্ত নড়াচড়ায় এবড়ো-খেবড়ো রূঢ় কাষ্ঠে পিঠ ঘষায় পিছনের সমস্ত স্থানের পেশীর কোষগুলো যেভাবে ছিঁড়ে ফেটে ক্ষত হয়, তাতে এই শুষ্ক ব্যথায় সে নিদারুণ যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। তারপর আরেকটি মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয় : বুকের মধ্যে অতিরিক্ত, একেবারে অসহনীয় বেজায় ব্যথায় হৃদযন্ত্রের চারপাশের থলিবিশেষে সেভাবে আস্তে আস্তে রক্তের জলীয় অংশে পূর্ণ হয় এবং হৃদপিন্ডে চাপ সৃষ্টি করে।
এই অবস্থা এখন প্রায় শেষের দিকে - পেশীর কোষগুলো তরল পদার্থ ঘাটতি হয়ে এক চরম সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় চলে আসে - হৃৎপিণ্ড কষ্টসহকারে টলতে টলতে পামপ্ করে পেশীর কোষগুলোর মধ্যে পরিমাণমত ঘন রক্ত ঠেলে দিতে যেন শান্ত হয়ে পরে - অসহ্য যন্ত্রণায় বাতাসের ছোট ছোট ঢোক হাঁ করে ফুসফুসে নেবার জন্য উত্তেজিত হয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে। সে অনুভব করতে পারে মৃত্যুর নিস্তেজ শীতিলতা তার দেহের কোষগুলো মধ্যে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসছে . . . পরিশেষে, সে তার দেহকে মৃত্যুকে প্রদান করে।

আর যদি সৈনিকেরা ক্রুশে এভাবে যন্ত্রণায় অপরাধীর মৃত্যুটা তারাতারি চাইতো তারা অপরাধীর পা ভেঁঙ্গে দিত, কারণ তাতে অপরাধী নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মুহূর্তেই মারা যেত। তবে সৈন্যরা যীশুর পা ভাঁঙ্গতে তাঁর কাছে এলে দেখলো যীশু ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। তাঁর দেহের কেনো হাড়ই ভাঁঙ্গা যাইনি, ভাববাণি পূর্ণ হয়েছে “তিনি তাঁহার অস্থি সকল রক্ষা করেন; তাহার মধ্যে একখানিও ভগ্ন হয় না” (গীতসংহিতা ৩৪:২০ পদ)

এভাবে যিরূশালেমের প্রান্তে কালভেরি নামক স্থানে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে চরম যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনার ভেতর দিয়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

প্রিয় পাঠক, আমাদের প্রভু যীশুর বিষয় সমস্ত কিছুই পবিত্র বাইবেলে সাক্ষ্য দেয় যে তাঁকে এভাবে মেরে ফেলা হয় ‘পরে তাহারা তাঁহাকে ক্রুশে দিল’ - মার্ক ১৫:২৪ পদ। বাইবেলের সুসমাচারের বিরাট অংশ জুড়ে এ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। আমরা জানি যে প্রভু যীশু তাঁর প্রাণ তাঁর দেহ থেকে বিদায় দিয়েছিলেন; এমনকি মৃত্যুর সময়ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁর ছিল।

তিনি আমাদের আহ্বান জানিয়েছেন যেন আমরা আমাদের সমস্ত হৃদয়, আমাদের সমস্ত মন, আমাদের সমস্ত প্রাণ দিয়ে, আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁকে আমাদের প্রভু, আমাদের ঈশ্বর বলে তাঁকে প্রেম করি !! আমরা কী তা এখনই করতে পারি না?

“অপূর্ব প্রেমে প্রভু এ জগতে মাতালে” (খ্রীষ্ট-সঙ্গীত নং ৭১) । আমেন !!

Comments

Popular posts from this blog

উপবাস - বাইবেলের আলোকে উপবাস

প্রতিমা পূজা এমনকি মূর্তি সম্পর্কে বাইবেল কী বলে? What does the Bible says about idolatry or even image?

ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করেছেন?