কোন্ দিন পালনীয় শনিবার না রবিবার?


লেখক : পাস্টর, সি ডি বলডুইন

ভূমিকা

সপ্তম দিনকে যারা বিশ্রামবার বলে পালন করেন (Seventh Day Adventist) বছর কয়েক আগে আমি নিজেও সেই সম্প্রদায়ভূক্ত ছিলাম। তাই সেই ধর্মমতের অনুগামীদের প্রতি আমার গভীর সহানুভূতি রয়েছে। তারাও খ্রীষ্টকে নিজেদের জীবনে গ্রহণ করতঃ, বিধানের বোঝা হতে উদ্ধারিত হয়ে খ্রীষ্টেতেই সম্পূর্ণ স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করুক - এই আমি চাই। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমি এই বইখানি রচনা করেছি।

এই খ্রীষ্টিয় ধর্ম সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছুটা সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।

১৭৮২ খ্রীষ্টব্দে আমেরিকায় উইলিয়ম মিলার নামে এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪০ সালে তিনি খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। ফলে কিছুলোক তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করে একটি দল গঠন করে। তখন তারা নিজেদের নামকরণ করেছিল Adventist বা আগমনকারী। প্রভু যীশু খ্রীষ্টের পুনরায় এ জগতে আর্বিভাব (Advent) ঘটবে - এই বিশ্বাসকেই তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের নামকরণের মধ্য দিয়ে ঘোষণা করল। এই দলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন জেমস হোয়াইট নামে এক ব্যক্তি। সম্প্রদায়ের গোড়া পত্তনের তিন বছর পরে জেমস হোয়াইট এর পত্নী একটি স্বপ্ন দেখেন। এই তরুণী ছিলেন অশিক্ষিতা। তিনি বললেন যে, স্বপ্নে তিনি দুটি প্রস্তরফলক দেখেছেন এবং সেই দুটির উপর খোদিত রয়েছে ঈশ^র প্রদত্ত সেই দশটি আজ্ঞা, যা তিনি মোশিকে দিয়েছিলেন। “বিশ্রামবারকে পবিত্ররূপে পালন করিও”Ñ দশ আজ্ঞার এই চতুর্থ আজ্ঞাটিকে ঘিরে একটি উজ্জ্বল আলোক মালা দেখতে পেলেন। মিসেস হোয়াইট দাবি করলেন, তাঁকে এই স্বপ্ন দেখিয়ে ঈশ্বর জগতের মানুষকে জানাতে চান যে, এই চতুর্থ আজ্ঞা পালন করাই মানব সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য। হোয়াইট দম্পতি ও তাঁদের দলের লোকেরা একমত হয়ে স্থির করলেন যে, এরপর থেকে চতুর্থ আজ্ঞা অনুসারে তাঁরা সপ্তম দিনকেই বিশ্রামবাররূপে পালন করবেন এবং তাঁদের সম্প্রদায়ের নাম হবে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট বা ‘সপ্তম দিনকে বিশ্রামবাররূপে পালনকারী’। এই সময় থেকেই তাঁরা সপ্তম দিবসকে (শনিবার) সাব্বাথ বা বিশ্রামবার বলে পালন করে আসছেন। বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে ১৮৪৪ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট বা সপ্তম দিনকে বিশ্রামবাররূপে পালনকারী ধর্ম সম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

THE GREAT CONTROVERSY (between Christ and Satan) নামক পুস্তকের মধ্যে Mrs. Ellen G. White সপ্তম দিনকে বিশ্রামবাররূপে পালনকারী (সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট) ধর্ম সম্প্রদায়ের ধর্ম শিক্ষা লিপিবদ্ধ করেছেন। এই পুস্তকটিকে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্টদের বাইবেল বললেও অত্যুক্তি হবে না। আমার এই পুস্তকটির বিভিন্ন স্থানে আমি THE GREAT CONTROVERSY পুস্তকের বিষয় আলোচনা করেছি এবং তার পৃষ্ঠার সংখ্যাও উল্লেখ করেছি। এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি পাঠ করে কেউ যদি উপকৃত হন তাহলে আমি আমার শ্রম সার্থক মনে করব।

বিনীত -
প্রচারক, সি ডি বলডুইন।

খ্রীষ্টিয়ানদের পক্ষে কোন্ দিন পালনীয় -
শনিবার না রবিবার?
প্রথম অধ্যায়
সেভেনথ্-ডে অ্যড্ভেনটিস্টদের চারটি মুখ্য শিক্ষা

১। ঈশ্বরের বিধান অপরিবর্তনীয়

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা বলে থাকে যে, ঈশ্বরের বিধান আদিতেই ছিল এবং ঈশ্বরের সংগেই ছিল। ঈশ্বর স্বয়ং অপরিবর্তনীয়। কাজেই তাঁর বিধানও অপরিবর্তনীয়। তাঁর বিধানের কোনো অংশের পরিবর্তন হতে পারে না।

এ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে বিধান বলতে কী বোঝায় তাই আমাদের স্থির করতে হবে। ঈশ্বরের বিধান বলতে আমরা কী বুঝি বা বোঝাতে চাই?

(ক) ঈশ্বর এবং তাঁর ন্যায় পরায়ণতা অভিন্ন। তাঁর নীতি বা নৈতিকবিধানের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। কাজেই ঈশ্বরের নৈতিক বিধান তাঁর মতোই চিরস্থায়ী। তার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেভেন্থ-ডে এ্যাড্ভেন্টিস্ট-দের এই শিক্ষার সংগে আমাদের কোনো অমত নেই। বাইবেলে কিন্তু ‘বিধান’ শব্দটির অন্য অর্থ পাওয়া যায়। সেই সম্বন্ধেও আলোচনা করা দরকার।

(খ)বিধান’ শব্দটি মানুষের প্রতি ঐশ্বরিক শাসনাধিকার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মানবজাতির চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে, তাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা অনুসারে ঈশ্বর মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন বিধান দিয়ে তাদের শাসন করে এসেছেন। (ইব্রীয় ১:১ পদ) এই উদ্দেশ্যে এবং পরায়ণতার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। সন্তানের কল্যাণের জন্য পিতা যেমন পড়ার বই, শিক্ষক কিম্বা স্কুল বদলাতে পারেন ঈশ্বরর তেমনি অবস্থা অনুযায়ী জাতি বিশেষের সম্বন্ধে তার বিধান পরিবর্তন করতে পারেন। 

“ঈশ্বর পূর্বাকালে বহুভাগে ও বহুরূপে ভাববাদিগণে, পিতৃলোকদিগকে কথা বলিয়া, এই শেষকালে পুত্রেই আমাদিগকে বলিয়াছেন।” (ইব্রীয় ১:১ পদ) এই পদটিই প্রমাণ করে যে, যদিও মানুষের কাছে তাঁর শিক্ষার বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য ঈশ্বর তাঁর পদ্ধতি নানা ভাবে পরিবর্তন করেছেন, তবুও ন্যায়পরায়ণতা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে, আর তাতে ঈশ্বরের কোনো অসঙ্গতি প্রকাশ পায়নি। ঈশ্বরের ন্যায়ের বিধান অপরিবর্তনীয় কিন্তু ঈশ্বরের সাময়িক বিধান পরিবর্তিত হতে পারে। সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা এই পার্থক্য উপলদ্ধি করতে পারেনি। ঈশ্বরের নৈতিক বিধান তাঁর ন্যায়পরায়ণতার মত চিরস্থায়ী ও অটল। কিন্তু ঈশ্বরের কয়েকটি বিধান সাময়িক। তিনি সেগুলো বদলাতে পারেন। তা যদি তিনি করতে না পারেন তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন।

মোশিকে প্রদত্ত ঈশ্বরের দশটি আজ্ঞা তাঁর ন্যায় বিধান বলে আমরা স্বীকার করি সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা দাবি করে যে, এই দশটি আজ্ঞা পালন করতেই হবে কিন্তু এর উত্তরে আমরা দেখিয়ে দিতে চাই যে, চতুর্থ আজ্ঞাটি নৈতিক আজ্ঞা নয়। সেই জন্যই খ্রীষ্টিয়ানদের পক্ষে এই আজ্ঞা পালন করা আবশ্যক নয়। আমরা দেখিয়ে দেব যে, বিশেষ স্থানে বিশেষ সময়ে, বিশেষ উদ্দেশ্যে জাতি বিশেষের কাছে এই চতুর্থ আজ্ঞাটি দেওয়া হয়েছিল। একথা মনে রাখা দরকার যে, ন্যায় বিধান দেওয়ার ৪৩০ বছর আগেই সুসমাচার প্রচারিত হয়েছিল (গালাতীয় ৩:৮,১৭)। ন্যায় বিধান কেন দেওয়া হয়েছিল ও কীভাবে তা রদ করা হলো - তাও আমরা পরে আলোচনা করব। কিন্তু চতুর্থ আজ্ঞাটি যে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল, সেইটিই আমরা এখানে প্রমাণ করব।

১।
পুরাতন নিয়ম : আমার ব্যতিরেকে তোমার অন্য দেবতা না থাকুক। 
যাত্রাপুস্তক ২০:৩ পদ
নতুন নিয়ম : এই সকল অসার বস্তু হইতে সেই জীবন্ত ঈশ্বরের প্রতি ফিরিয়া আসিতে হইবে।
প্রেরিত ১৪:১৫ পদ।  

২।   পুরাতন নিয়ম : তুমি আপনার নিমিত্ত খোদিত প্রতিমা নির্মাণ করিও না। 
যাত্রাপুস্তক ২০:৪,৫ পদ
নতুন নিয়ম : তোমরা প্রতিমাগণ হইতে আপনাদিগকে রক্ষা করিও। ১যোহন ৫:২১ পদ,
১করিন্থীয় ১০:১৪ পদ।
৩। পুরাতন নিয়ম : তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভুর নাম অনর্থক লইও না . . . ৭ পদ
নতুন নিয়ম : দিব্য করিও না . . . যাকোব ৫:১২ পদ।

৪।   পুরাতন নিয়ম : তুমি বিশ্রামবার স্মরণ করিয়া পবিত্র করিও . . . সপ্তম দিন . . . কোনো কার্য্য করিও না . . . ৮-১১ পদ
নতুন নিয়ম :

৫।   পুরাতন নিয়ম : তোমার পিতামাতাকে সমাদর করিও . . . ১২ পদ।
নতুন নিয়ম : পিতামাতার আজ্ঞাবহ হইও। ইফিষীয় ৬:১,২ পদ।

৬। পুরাতন নিয়ম : নরহত্যা করিও না . . . ১৩ পদ।
নতুন নিয়ম : নরহত্যা করিও না। রোমীয় ১৩:২ পদ, ১যোহন ৩:১৫ পদ

৭। পুরাতন নিয়ম : ব্যভিচার করিও না . . . ১৪ পদ।
নতুন নিয়ম : ব্যভিচার করিও না । রোমীয় ১৩:৯ পদ, ১করিন্থীয় ৬:৯,১০, ১৫-১৮ পদ

৮। পুরাতন নিয়ম : চুরি করিও না . . . ১৫ পদ।
নতুন নিয়ম : চুরি করিও না ...। রোমীয় ১৩:১৩:৯ পদ, ইফিষীয় ৪:২৮ পদ 

৯।
পুরাতন নিয়ম : মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না . . . ১৬ পদ।
নতুন নিয়ম : মিথ্যা কথা কহিও না। কলসীয় ৩:৯ পদ

১০।
পুরাতন নিয়ম : লোভ করিও না . . . ১৭ পদ।
নতুন নিয়ম : লোভ করিও না । রোমীয় ১৩:৯ পদ, ইফিষীয় ৫:৩ পদ, ইব্রীয় ১৩:৫ পদ

পাাঠক পাঠিকারা লক্ষ্য করবেন যে চতুর্থ আজ্ঞাটি নতুন নিয়মের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। একান্ত অকারণে যে এটি করা হয়েছে, তা নয়। পবিত্র আত্মা স্বয়ংই এই চতুর্থ আজ্ঞাটিকে নতুন নিয়ম থেকে বাদ দিয়েছেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে বিশ্রামবার পালন সম্বন্ধীয় আজ্ঞাটি নৈতিক বিধান সম্মত নয়। শাস্ত্রমতে বিশ্রামবার পালন প্রতীক অনুষ্ঠান মাত্র (ইব্রীয় ১০:১ পদ); মূল বিষয়টি হলো আত্মিক নিবৃত্তি, যা খ্রীষ্টের মধ্যে খ্রীষ্টিয়ানরা খুঁজে পায় (ইব্রীয় ৪:৩-১১ পদ)। ন্যায়বিধান সম্মত কোনো কাজ দিয়ে এটি লাভ করা যায় না। কাজেই খ্রীষ্টিয়ানের পক্ষে চর্তুথ আজ্ঞা পালনের কোনো আবশ্যকতা নেই। সপ্তম দিনটি যিহুদীয় বিশ্রামবাররূপে পালন করার কোনো আদেশ খ্রীষ্টিয়ানদের দেওয়া হয়নি।
(গ) চতুর্থ আজ্ঞাটি খারিজ বা রহিত হওয়া সম্বন্ধে দুটি ভবিষ্যৎ বাণী আমাদের বিবেচনা করা উচিত। 
(১) “প্রথম দিবস বিশ্রাম পর্ব ও অষ্টম দিবস বিশ্রাম পর্ব হইলে” - (লেবীয় ২৩:৩৯ পদ)। এই পদ অনুসারে রবিবার শনিবারের স্থান গ্রহণ করবে। এই ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ হলো কখন? খ্রীষ্টিয়ানেরা যখন পঞ্চাশত্তমীর দিনে সমবেত হলো, তখনই এই ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ হয়েছিল। সপ্তম দিন (শনিবার) যিহুদীয় বিশ্রামবার ছিল। এর সঙ্গে আর একদিন যোগ করলে অষ্টম দিন হয়। সেই অষ্টম দিনটি ছিল রবিবার।
(২) ঈশ্বর বলেন,“আমি তাহার বিশ্রাম দিন . . .  রহিত  করিব” - (হোশেয় ২:১১ পদ) এর প্রকৃত অনুবাদ হবে, “আমি তাহার বিশ্রামদিন রহিত করাইব।” “তাহার” শব্দটি দিয়ে ইস্রায়েল জাতিকেই বোঝান হয়েছে। যীশু যে এই ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ করলেন ও সেই যিহুদীয় বিশ্রামবার রহিত করালেন তার প্রমাণ নীচে দেওয়া হলো : - “মৃতগণের মধ্য হইতে উঠিলে পর যীশু এখন এই তৃতীয়বার আপন শিষ্যদিগকে দর্শন দিলেন।” (যোহন ২১:১৪ পদ) তবে এর আগে দুবার তিনি নিজের শিষ্যদের দর্শন দিয়েছিলেন। প্রথম দর্শন দিয়েছিলেন পুনরুত্থানের দিনেই অর্থাৎ রবিবারে (যোহন ২০:১,১৯ পদ)। দ্বিতীয়বার দর্শন দিয়েছিলেন ‘আট দিন পরে’। সেদিনও ছিল রবিবার (যোহন ২০:২৬ পদ)। তৃতীয়বার দর্শন দিলেন তিবিরিয়া সমুদ্রের তীরে (যোহন ২১:১,১৪ পদ)।

এতে দেখা যায় যে পুনরুত্থানের পর যীশু কোনো বিশ্রামবারে (সপ্তম দিনে) তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে দেখা করেননি। অবশ্য তিনি তা করতে পারতেন কিন্তু ইচ্ছে করে শনিবার দিনটি বাদ দিয়ে রবিবারেই তিনি তাঁদের দর্শন দিয়েছিলেন - অর্থাৎ তিনি সেই যিহুদীয় বা ইস্রায়েল জাতির বিশ্রামবার এভাবে খারিজ করে দিলেন এবং এর দ্বারা তিনি হোশেয় ২:১১ পদের ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ করলেন।
৩) তিনি আরও বলেন,“মনুষ্য পুত্র বিশ্রামবারেরও কর্তা।”

(মার্ক ২:২৮ পদ) সেই দিনটির ওপর তিনি কর্তৃত্ত্ব করেন। দিনটি তাঁর ওপর কর্তৃত্ত্ব করতে পারে না। যেহেতু বিশ্রামবারের কর্তৃত্ত্ব তাঁরই সেহেতু যারা “খ্রীষ্টেতে” আছে, তাদেরও বিশ্রামবারের ওপর কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। খ্রীষ্টিয়ানদের এটি ন্যায্য অধিকার। এই অধিকার বলেই তারা সকলেই “বিশ্রামবারের কর্তা।” - যে বিশ্রামবার যীশু খারিজ করে দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় অধ্যায় বিশ্রামবারকে খারিজ করে দেওয়া সম্বন্ধে একটি অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। ঈশ্বরের বিধান অপরিবর্তনীয় - সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের এই দাবি যথার্থ নয়, সে সম্বন্ধে যুক্তিসহ সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছালাম।  

২। দ্বিবিধ বিধানের কল্পনা

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা দাবি করে যে বাইবেলে দ্বিবিধ বিধান বিদ্যমান; একটি ঈশ্বরের ন্যায় বা নৈতিক বিধান, অপরটি নানা ক্রিয়া কা- বা অনুষ্ঠান পদ্ধতি সম্বন্ধীয় বিধি। প্রথমটিকে তারা “ঈশ্বরের বিধান” নামে অভিহিত করে। দ্বিতীয়টিকে তারা বলে ‘মোশির বিধান। তাদের এই দাবি যথার্থ কি না, তা আমাদের দেখা দরকার। আমাদের ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত দুটি পদ তাদের ভ্রান্তি প্রতিপাদন করবে।

ক। “ইষ্রাকে মোশির ব্যবস্থা-পুস্তক আনিতে কহিল। তারা সেই পুস্তক, ঈশ্বরের ব্যবস্থা পাঠ করল”। (নহিমিয় ৮:১,৮ পদ) 

“ব্যবস্থা পুস্তকের বাক্য শ্রবণে সমস্ত লোক রোদন করিতেছিল। . . . ইষ্রা . . . প্রতিদিন ঈশ্বরের ব্যবস্থা পুস্তক পাঠ করিলেন। (নহিমিয় ৮: ৯ ও ১৮ পদ) দুটি জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে মোশির বিধানই ‘ঈশ্বরের বিধান’ নামে অভিহিত হয়েছে। সুতরাং ‘মোশির বিধান’ ও ঈশ্বরের বিধান’ একই বিধান, দ্বিবিধ বিধান নয়। 

খ। কোনো একটি প্রশ্নের উত্তরে যীশু বলেছিলেন : . . . তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে। . . . তোমার প্রতিবাসীকে . . . প্রেম করিবে। এই দুটি আজ্ঞাতেই সমস্ত ব্যবস্থা এবং ভাববাদি গ্রন্থ ঝুলিতেছে।” (মথি ২২:৩৭-৪৭)

এই দুইটি আজ্ঞাই নৈতিক আজ্ঞা। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উভয় আজ্ঞাই ‘মোশির বিধান’ থেকে উদ্ধৃত। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৫ পদ; লেবীয় ১৯১৮ পদ) সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের মতে এই দুই পুস্তকের মধ্যে বিভিন্ন বাহ্যিক ক্রিয়াকা- বা অনুষ্ঠান পদ্ধতি ইত্যাদি বর্ণিত রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখি যে, যীশুর কথা অনুযায়ী সবচেয়ে বড় নৈতিক আজ্ঞা দুইটিও এই পুস্তকেই লিপিবদ্ধ ওয়েছে। এর ফলে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের দ্বিবিধ বিধানের মত খারিজ হয়ে গেছে।

গ। মথি ২২:৪০ পদ এবং লূক ১৬:১৬ পদ পাঠ করলে, উভয় পদেই ‘ব্যবস্থা’ অর্থাৎ বিধান শব্দটি লক্ষ্য পাওয়া যায়, প্রায়ই সেসব জায়গায় আমরা গ্রিক ভাষায় ‘হো নমস্’ শব্দটি পাই। ‘হো নমস্’ শব্দর অর্থ সম্পূর্ণ ব্যবস্থা। এর মধ্যে দুই ধরণের ব্যবস্থার লেশমাত্র আভাষও নেই।

এই আলোচনায় যে যুক্তি প্রমাণ আমরা উপস্থিত করলাম তাতে দেখা যায় যে, সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের এই দ্বিবিধ বিধানের কল্পনা শাস্ত্রের শিক্ষা অনুযায়ী নস্যাৎ হয়ে যায়। এই কারণে তাদের অভিমতকে আমরা ভ্রান্ত শিক্ষা বলে গণ্য না করে পারি না।

৩।  বিশ্রামবার (সপ্তম দিন বা যিহুদীয় শাব্বাথ) নিত্যস্থায়ী। 

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট দাবি করে যে বিশ্রামবার চিরকালের জন্য পালনীয় এবং এই দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ “এই দিনকে সদাপ্রভুর উৎসব বলিয়া পালন করিবে; পুরুষানুক্রমে চিরস্থায়ী বিধিমতে এই উৎসব পালন করিবে।” (যাত্রা ১২:১৪ পদ) পদটি উপস্থিত করে।

শাস্ত্র পাঠ করলে দেখা যায় যে ধুপ জ্বালান (যাত্রাপুস্তক ৩০:৮ পদ) প্রায়শ্চিত্ত (যাত্রাপুস্তক ৩০:১০ পদ) হস্ত ও পদ ধৌত করা (৩০:২১ পদ), নৈবদ্য (লেবীয় ৬:১৫,১৮ পদ), শস্যের অগ্রিমাংশ দান (লেবীয় ২৩:১০ পদ) হোমবলি, ভক্ষ্য নৈবেদ্য ও পেয় নৈবেদ্য (লেবীয় ২৩:১৮ পদ), কুটিরোৎসব (লেবীয় ২৩:৩৪,৪১ পদ), থোপ ও নীল সূত্র নিজেদের পরিধেয় বস্ত্রের কোণে ব্যবহার (গণনা ১৫:৩৮ পদ) প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধেও “পুরুষানুক্রমে” “নিয়ত” বা “চিরস্থায়ী” ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, সপ্তম দিন পালনকারী দল কোন্ যুক্তিতে অন্যান্য ব্যবস্থা বা বিধানগুলোকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র একটি ব্যবস্থার উপর এত জোর দেয়? যখন উল্লিখিত বিভিন্ন উৎসব, ব্যবস্থা বা বিধি সম্বন্ধে “পরুষানুক্রমে” “নিয়ত” বা “চিরস্থায়ী” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে, তখন এগুলোর তাদের পালন করা উচিত নয় কি? কিন্তু এই দল শুধু বিশ্রামবার পালনের ওপরেই “পুরুষানুক্রমে” শব্দটি চাপিয়ে দেয়া এবং অন্যান্য “পুরুষানুক্রমে” পালনীয়” ব্যবস্থা বা বিধি ভুুলে যায় এটি অসঙ্গত নয় কি?

এদের আর একটি যুক্তি আলোচনা করে দেখা যাক। “সে পরাৎপরের নিরূপিত সময়ের ও ব্যবস্থার পরিবর্তন করিতে মনস্থ করিবে” (দানিয়েল ৭:২৫ পদ) এই পদটি উদ্ধৃত করে তারা দাবি করে Ñ বিশ্রামবার যে পরিবর্তিত হয়েছে, এই পদই তার প্রমাণ তারা আরও দাবি করে যে সম্রাট কন্স্টানটিন এই কাজ করেছিলেন।

এর উত্তরে আমরা বলি :

(১) দানিয়েল ভাববাদীগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত উল্লিখিত পদটি যে নিশ্চিতভাবে সম্রাট কন্স্টানটিন সম্বন্ধীয় এ কথা প্রমাণ করা অসম্ভব।

(২) উদ্ধৃত পদটিতে লেখা আছে, “সে . . . মনস্থ করিবে”, একথা বলা হয়নি যে “সে নিরূপিত সময়েরও ব্যবস্থার পরিবর্তন করেছিল।” বলা হয়েছে যে সে তা করতে “মনস্থ” করেছিল। মনস্থ করা ও মনের সেই চিন্তাকে কর্যে পরিণত করা - এই দুইয়ের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান।

(৩) “নিরুপিত সময়” ও নিরূপিত দিন - একই অর্থবোধক নয়। আবার “ব্যবস্থা” শব্দের অর্থও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। কার ব্যবস্থা? ঈশ্বরের, না কোনো রাজার অথবা সম্রাট কন্স্টানটিনের নিজের ব্যবস্থা? একথা যখন স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, তখন ঈশ্বর প্রদত্ত সেই দশ আজ্ঞার অন্তর্ভ্ক্তূ চতুর্থ আজ্ঞাটি সম্বন্ধে এ ধরণের ব্যাখ্যা করা একান্ত যুক্তিহীন বিচার নয় কি?

প্রকৃত ঘটনা হলো এই - সম্রাট কন্স্টানটিনের আমলে তাঁর সাম্রাজ্যের অধিকাংশ লোকই খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী ছিল। প্রায় ৩০০ বৎসর ধরে খ্রীষ্টিয়ানরা রবিবারকে “প্রভুর দিন” রূপে (প্রকাশিত বাক্য ১:১০ পদ) পালন করে আসছিল। সেই দিনটিতে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজ কর্ম থেকে বিশ্রাম গ্রহণ করত আর ঈশ্বরের উপাসনা করত। কিন্তু যারা খ্রীষ্টিয়ান ছিল না, তারা তাদের বিভিন্ন রীতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন দিনে বিশ্রাম গ্রহণ করত। এতে সাম্রাজ্যের কাজে কর্মে নানা অসুবিধা দেখা দিত। তাই সম্রাট তাঁর প্রজাদের অধিকাংশের অনুসৃত প্রথা অনুমোদন করে আইন সিদ্ধ করলেন যাতে হাটে বাজারে কেনা-বেচা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতির অসুবিধা দূর হয়। এ সম্বন্ধে ৩২১ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট কন্স্টানটিন লেখেন, অন্যান্য কাজ কর্ম করুক যাতে ফসল নষ্ট না হয়। আর বিচারকেরা ও নগর বাসীদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব তারা সুর্যের সম্মানসূচক দিনটিতে (বর্তমান যুগের রবিবারকে বুঝান হয়েছে) বিশ্রাম করুক।”

কিন্তু এর দ্বারা বিশ্রামবারের যে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি এটিই লক্ষ্যনীয়।

কোনো খ্রীষ্টিয়ানই রবিবারকে যিহুদীয় বিশ্রামবার বলে পালন করে না। তারা সেই দিনটিকে পালন করে “প্রভুর দিন” রূপে। তাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের পুনরুথানের স্মরণার্থে তারা সেই দিনটি পালন করে আর ঈশ্বরের আরাধনা করার উদ্দেশ্যে যতদূর সম্ভব অন্যান্য কাজকর্ম থেকে বিরত হয়। আজকের দিনেও কেউই সেই দিনটিকে শাব্বাথরূপে পালন করতে পারে না, কারণ সেই দিন সম্বন্ধে লেখা আছে, “সে দিন কোনো কার্য্যই করিও না” (যাত্রাপুস্তক ২০:৮-১০ পদ) কোনো কার্যের অর্থ হলো যে কোনো কাজ। লেখা রয়েছে, “সেই বিশ্রামদিনে যে কোনো কার্য করিবে, তাহার প্রাণদ- অবশ্য হইবে।” (যাত্রাপুস্তক ৩১:১৫ পদ এই আজ্ঞা সত্ত্বেও সপ্তমদিন পালনকারী দল নিজেরাই বিশ্রামবার সম্বন্ধীয় অনেক আইন লঙ্ঘন করে। যেমন - “বিশ্রামবারের পথ” (প্রেরিত ১:১২ পদ)। বিশ্রামবারের পথ অনুমান ২০০০ হাত। অনেকেই এই আজ্ঞা পালন করে না। যাত্রাপুস্তক ৩৫:৩ পদে লেখা আছে, “তোমরা বিশ্রাম দিনে আপনাদের কোনো বাসস্থানে অগ্নি জ্বালিও না।” এই আজ্ঞাটি কতজন পালন করে? সপ্তমদিন পালনকারী দল নিজেরাই এই ধরণের বহু বিধিব্যবস্থা পালন না করে নিজেরাই দোষী সাব্যস্ত হয়ে পড়েছে অথচ যারা রবিবার পালন করে, তাদের তারা বিশ্রামবার পালন করে না বলে নিন্দা করে।

৪। শনিবার প্রকৃত বিশ্রাম দিন

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা এই শিক্ষা দিয়ে থাকে যে এখনকার প্রচলিত সপ্তাহের সপ্তম দিন এবং সেই সপ্তমদিন - যে দিন ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির কাজ শেষ করে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন, সেই উভয় দিনই একই দিন। আর যেহেতু ঈশ্বর সেই সপ্তম দিনকে আর্শীবাদ করে সেই দিনটিকে পালন করার জন্য আদমকে আদেশ দিয়েছিলেন, ঈশ্বর ভক্তদের সেই হেতু কর্তব্য সেই আদি বিশ্রাম দিন পালন করা।

(ক) সেই আদি সপ্তম দিনকে ২৪ ঘন্টার দিন হিসাবে ধরলেও একথা কেউ প্রমাণ করতে পারে না যে সেই প্রাথমিক সপ্তম দিন এবং আমাদের এই বর্তমান যুগের শনিবার একই দিন। সর্বগ্রে এই বৈজ্ঞানিক তথ্যটি আমাদের অনুধাবন করা দরকার। সেই সংগে আর একটি বিষয় আমাদের লক্ষ্য করা উচিত। সেই বিষয়টি হলো এই : সৃষ্টির বিবরণে প্রথম দিন থেকে ষষ্ঠদিন পর্যন্ত উল্লেখ আছে : “আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হলো” - (আদিপুস্তক ১:৫,৮,১৩,১৯,২৩,৩১ পদ)। কিন্তু সপ্তম দিন সম্বন্ধে এই বাক্যটি লেখা হয়নি। সপ্তম দিনটি শেষ হওয়া সম্বন্ধে ঐশ্বরিক লেখক (পবিত্র আত্মা) নীরব। এতে আমাদের এ কথাই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সেই সপ্তম দিন সমাপ্ত হয়নি। তা এখন পর্যন্ত চলছে। ছয় দিনের মধ্যে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টিকার্য শেষ করেন। কিন্তু ষষ্ঠদিনের পর (তাঁরই সপ্তম দিনে) তিনি তাঁর “সমস্ত সৃষ্টির” মুক্তির কার্যে ব্যাপৃত রয়েছেন (রোমীয় ৮:২২,২৩ পদ)। আদিপুস্তক ২:২ ও ৩ পদে সপ্তম দিনকে “বিশ্রামবার” বলা হয়নি, বলা হয়েছে “ঈশ্বরের বিশ্রাম” অর্থাৎ সৃষ্টিকার্য থেকে বিশ্রাম। সুতরাং সেই আদি প্রাথমিক সপ্তম দিন সাপ্তাহিক ২৪ ঘন্টার মাপা দিন ছিল না বরং সেই সপ্তম দিন অতি দীর্ঘ সময় যা বরাবর চলে আসছে ও আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। আদিপুস্তক ২:৪ পদে ছয় দিনকে একদিন বলা হয়েছে।

“শাব্বাথ” বা বিশ্রামবার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পালন করার কোনো নির্দেশই আদি পুস্তকের মধ্যে নেই। ঈশ্বর আদমকেও সপ্তম দিন পবিত্র বিশ্রাম দিনরূপে পালন করার আদেশ দেননি। আদম থেকে মোশি পর্যন্ত যিহুদী জাতির পিতৃ পুরুষদের মধ্যে কেউ যে বিশ্রামবার পালন করেছিলেন এমন উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। ঈশ্বর যে সপ্তম দিন পালন করতে কোনো আজ্ঞা দেন তার অকাট্য প্রমাণ দেওয়া হলো :-

(খ) বিশ্রাম দিন কবে এবং কাকে দেওয়া হয়েছিল?

(১) নহিমিয় ৯:১১-১৪ পদে লেখা আছে - “তুমি তাহাদের সম্মুখে সমুদ্রকে দ্বিভাগ করিলে . . . তুমি সীনয় পর্বতের উপরে নামিয়া আসিলে, . . . সত্য ব্যবস্থা, উত্তম বিধি ও আজ্ঞা তাহাদিগকে দিলে; এবং আপনার পবিত্র বিশ্রামবার তাহাদিগকে জ্ঞাত করিলে এবং আপন দাস মোশি দ্বারা তাহাদিগকে আজ্ঞা বিধি ও ব্যবস্থা দিলে।”

শাস্ত্রেও এই পদ থেকে সুস্পষ্ট ভাবেই প্রমাণিত হয় যে প্রান্তরে অবস্থিত সীনয় পর্বত থেকে মোশির মারফৎ ঈশ্বর যিহুদী জাতিকে বিশ্রামবার সম্বন্ধে জ্ঞাত করেছিলেন, এর আগে নয়। এর প্রমাণ দ্বিতীয় বিবরণ ৫:৩ পদে পাওয়া যায়।

(২) যিহুদী জাতিকে বিশ্রামবার জ্ঞাত করার পরই ঈশ্বর সেই বিশ্রাম দিন তাদের চিহ্নস্বরূপ দিলেন। ঈশ্বর বললেন : “ছয়দিন কার্য করা হইবে, কিন্তু সপ্তমদিন সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে বিশ্রামার্থক পবিত্র দিন . . . আমার ও ইস্রায়েল সন্তানগণের মধ্যে ইহা চিরস্থায়ী চিহ্ন।” (যাত্রাপুস্তক ৩১:১৫-১৭) এই পদের সংগে দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৫ পদ যিহিষ্কেল ২০:১২ পদ পাঠ করা দরকার।

(৩) যিহুদী জাতিকে বিশ্রামবার জ্ঞাত করার পর এবং সেই দিনটি চিহ্নস্বরূপ দেওয়ার পরেই ঈশ্বর তাদের সেই দিনটি স্মরণ ও পালন করতে আদেশ করলেন। তিনি বললেন : “তুমি বিশ্রাম স্মরণ করিয়া পবিত্র করিও” (যাত্রাপুস্তক ২০:৮ পদ)। এই পদেও আগে বাইবেলের কোনো স্থানে সপ্তম দিন এই ভাষায় (অর্থাৎ “সদাপ্রভুর উদ্দেশে বিশ্রামবার”) বর্ণিত হয়নি। এখানে যাত্রা ১৬ অধ্যায় পাঠ করা দরকার কিন্তু লক্ষ্যের বিষয় এই যে দশটি আজ্ঞা দেওয়ার আশায়ই এই অধ্যায়ের সমস্ত ক্রিয়াগুলো ভবিষ্যতকাল বাচক। এ দ্বারা বুঝা যায় যে যাত্রা ১৬ অধ্যায়ের আগে বিশ্রামবার পালন সম্বন্ধে কেউই জানত না। 

এই উদ্ধৃত শাস্ত্রাংশ থেকে আমরা অন্ততঃ তিনটি সিদ্ধান্তে উপনীত হই :

  (ক) আদমকে নয় কিন্তু বহু বছর পরে মোশির মারফতে বিশ্রামবার যিহুদী জাতিকে জ্ঞাত করা হলো।

  (খ) ঈশ্বর ও যিহুদী জাতির মধ্যেই বিশ্রামবারকে চিহ্নস্বরূপ করা হলো।

 (গ) বিশ্রামবারকে চিহ্নরূপে নির্দিষ্ট করার পরই সেই সপ্তম দিন স্মরণ ও পালন করতে যিহুদী জাতিকেই আদেশ দেওয়া হলো।

(গ) মিশর দেশে তারা যে পরাধীন বা দাস ছিল সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই বিশ্রামবার যিহুদী জাতিকে দেওয়া হলো। “স্মরণে রাখিও, মিশর দেশে তুমি দাস ছিলে, কিন্তু তোমরা ঈশ্বর . . . তথা হইতে তোমাকে বাহির করিয়া আনিলেন, এই জন্য তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু বিশ্রাম দিন পালন করিতে তোমাকে আজ্ঞা করিয়াছেন” - (দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৫ পদ)। ইস্রায়েল জাতি ও বর্তমান যুগের খ্রীষ্টিয় ম-লী এক জাতি নয়। আমরা খ্রীষ্টিয়ানরা কোনো দিনই মিশর দেশে কারো অধীনতায় বা দাসত্ব বন্দি ছিলাম না এবং সেই দেশ থেকে আমাদের মুক্ত করে নিয়ে আসাও হয়নি। কাজেই উল্লিখিত আজ্ঞা শুধু যিহুদী জাতির পক্ষেই প্রযোজ্য। খ্রীষ্টিয়ানদের পক্ষে তা অপ্রাসঙ্গিক। যিহুদী জাতির জন্য নির্দিষ্ট উদ্ধৃত পদটি বিশেষ অর্থবহ কিন্তু খ্রীষ্টিয়ানদের পক্ষে অর্থহীন।

এই আলোচনায় দেখা গেল যে বিশ্রামবার পালন করার আজ্ঞাটি যিহুদী জাতির উপরই প্রযোজ্য (যাত্রাপুস্তক ২০:১; ৩১:১৩ পদ)। আপনাকে যদি কেউ কিছু দান করেন, তবে সে দান কি একান্তভাবে আপনারই নয়? অনুরূপভাবে বিশ্রামবারও যিহুদীদেরই দেওয়া হয়েছে। সেই কারণে বিশ্রামবার তাদেরই পরজাতীয় লোকদের নয়। বিশ্রামবারটি খ্রীষ্টিয় ম-লীকে দেওয়া হয়নি, সুতরাং বিশ্রামবার, যা যিহুদীয় বিশ্রামবাররূপে নির্দিষ্ট, খ্রীষ্টিয়ানদের তা পালন করা বিধেয় নয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়
বিধান বাতিলের প্রমাণ

১। সাধু পৌলের শিক্ষা

সাধু পৌল বলেছেন’  যে পর্যন্ত না সেই বংশ আইসেন” সেই পর্যন্ত বিধান সকলের ওপরে রাজত্ব করেছে (গালাতীয় ৩:১৯ পদ)। তাঁর বক্তব্য আরও স্পষ্ট করে বুঝার জন্য তিনি সেই বংশের উল্লেখ করে বলেছিলেন, “সেই বংশ খ্রীষ্ট” (১৬ পদ) এবং যীশু খ্রীষ্ট আসার আগে পর্যন্ত বিধান-এর শাসনকাল অপ্রতিহত ছিল। প্রভু যীশুর আগমনের আগে যা ছিল, অর্থাৎ বিধান, তা হলো দুঃসমাচার। এই দুঃসমাচারের বাণী শুনে লোকে ভয়ে দিন কাটাত। কারণ এই দুঃসমাচার ছিল “পাপের বেতন মৃত্যু।” কিন্তু যীশু খ্রীষ্টের আগমনের পর সুসমাচার প্রচারিত হলো’ যাহারা ব্যবস্থার ক্রিয়াবলম্বী, তাহারা সকলে শাপের অধীন . . . খ্রীষ্টই মূল্য দিয়া আমাদিগকে ব্যবস্থার শাপ হইতে মুক্ত করিয়াছেন, কারণ তিনি আমাদের নিমিত্তে শাপস্বরূপ হইলেন।” (গালাতীয় ৩:১০,১৩ পদ)। এইটি হলো সু-সমাচার।

প্রেরিত পুরুষ পৌল লিখেছেন : “ব্যবস্থা খ্রীষ্টের কাছে আনিবার জন্য আমাদের পরিচালক দাস (চাকর) হইয়া উঠিল, যেন আমরা বিশ্বাস হেতু ধার্মিক গণিত হই। কিন্তু যে অবধি বিশ্বাস আসিল, সেই অবধি আমরা আর পরিচালক দাসের অধীন নহি” (গালাতীয় ৩:২৪,২৫ পদ)। এর চেয়ে সুস্পষ্টতা বাইবেল শাস্ত্রের আর কোথাও আছে কি? কাজেই দেখা যাচ্ছে, খ্রীষ্টিয়ান যে সে বিধানের বন্ধন থেকে যুক্ত।

২১ পদে তিনি বলেছেন : “যদি এমন ব্যবস্থা দত্ত হইত, যাহা জীবন দান করিতে পারে, তবে ধার্মিকতা অবশ্য বাধ্যতা অথবা ব্যবস্থামূলক হইত।

এ ধরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকার দরুণ ঈশ্বর মানুষকে অনন্ত জীবন দেবার জন্য অন্য একটি উপায় করে দিলেন। এ সম্বন্ধে পৌল বলছেন, “কিন্তু শাস্ত্র সকলেই পাপের অধীনতায় রুদ্ধ করিয়াছে, যেন . . . যীশু খ্রীষ্টে বিশ্বাস হেতু বিশ্বাসীদিগকে (সেই ধার্মিকতা ও জীবন) দেওয়া যায়।”(২২ পদ)

খ্রীষ্টিয়ানদের বলা হয়েছে : “যাজকত্ব যখন পরিবর্তিত হয়, তখন ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়, ইহা আবশ্যক।” (ইব্রীয় ৭:১২ পদ) এবং “পূর্বেকার বিধির দুর্বলতা ও নিষ্ফলতা প্রযুক্ত তাহার লোপ হইতেছে Ñ কেননা ব্যবস্থা কিছুই সিদ্ধ করে নাই” তাই “এমন এক শ্রেষ্ট প্রত্যাশা আনা হইতেছে, যদ্বারা আমরা ঈশ্বরের নিকটে উপস্থিত হই” (১৮ পদ)। ব্যবস্থা বা বিধান কোনো কিছুকেই পূূর্ণতা দান করেনি বলেই পাপিষ্ট মানুষ যাতে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ধার্মিক ও পূর্ণ সিদ্ধ মানবরূপে পরিগণিত হয় সেই জন্য অন্য বিধান প্রবর্তন করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও খ্রীষ্টিয়ানেরা “ব্যবস্থাহীন নয় বরং খ্রীষ্টের ব্যবস্থার অনগত”-ই রয়েছে (১ করিন্থীয় ৯:২১ পদ)। “কারণ ঐ প্রথম নিয়ম (বিধান বা ব্যবস্থা) যদি নির্দোষ হইত, তবে দ্বিতীয় এক নিয়মের জন্য স্থানের চেষ্টা করা যাইত না’ (ইব্রীয় ৮:৭ পদ)। বিধান ব্যবস্থা ক্রটিযুক্ত ছিল এবং তা মেনে চলত বলেই সেই ক্রটিযুক্ত বিধান অনুযায়ী লোকে দোষী সাব্যস্ত হতো। তাই প্রথম বারের অপূর্ণ ও ক্রটিযুক্ত বিধানকে বাতিল করে দিয়ে একটি ক্রটিহীন পূর্ণ বিধান (পূর্বেক্ত “খ্রীষ্টের ব্যবস্থা”) প্রবর্তিত হলো। এ সর্ম্পকে লেখা হয়েছে : “তিনি (ঈশ্বর) প্রথম বিষয় (বিধান) লোপ করিতেছেন যেন দ্বিতীয় বিষয় (খ্রীষ্টেতেই পাপীদের প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহ) স্থির করেন . . . যদ্বারা আমরা পবিত্রীকৃত হইয়া রহিয়াছি।” (ইব্রীয় ১০:৯-১০ পদে এ বিষয়ে পৌল বলেন, খ্রীষ্টিয়ানেরা “ব্যবস্থার অধীন নয়” (রোমীয় ৬:১৪ পদ)। কিন্তু এক্ষণে আমরা ব্যবস্থা হইতে মুক্ত হইয়াছি” (রোমীয় ৭:৬ পদ) এবং গালাতীয় খ্রীষ্টিয়ানদের কাছে তাঁর লেখা পত্রে তিনি বলেন, “তোমরা ব্যবস্থার অধীন নও” (গালাতীয় ৫:১৮ পদ)।

কলসীয় খ্রীষ্টিয়ানদের কাছে বিধান বাতিল হওয়ার বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়ে সাধু পৌল লেখেন,“আমাদের প্রতিকূল যে বিধিবদ্ধ হস্তলেখ্য (১০টি আজ্ঞা - দ্বিতীয় বিবরণ ১০:২,৪ পদ) আমাদের বিরুদ্ধ ছিল, তাহা মুছিয়া ফেলিয়াছেন এবং ক্রুশে প্রেকবিদ্ধ করিয়া দূর করিয়াছেন” (কলসীয় ২:১৪ পদ)। যিহুদীদের দেওয়ানি আইন অনুযায়ী বন্ধক দাতা তার বন্ধকী ঋৃণ শোধ করে দিয়ে নিজের বাড়ীর দরজায় বন্ধকনামাটি প্রেক গেথে লটকে দিয়ে সকলকে দেখাত যে, সে ঋৃণ মুক্ত হয়েছে। এই উদাহরণ দিয়ে সাধু পৌল বলেন যে, ঠিক সেইভাবে বিধানটি বন্ধকনামা স্বরূপ ক্রুশারোপিত যীশুর হাতে পায়ে প্রেক দিয়ে লটকে (যীশুই দ্বার - যোহন ১০:৯ পদ) দেওয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা সকলকে দেখান হচ্ছে বিধান বা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের যে ঋৃণ তা পরিশোধ করা হয়েছে। পৌলের যুক্তি হলো এই বিশ্বাসের মাধ্যমে যারা খ্রীষ্টেতে রয়েছে, যীশুর মতো তারাও সেই পাপরূপ থেকে মুক্ত এবং বিধান পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে তারা রেহাই পেয়েছে।   

আর একটি উদাহরণ যোগে পৌল বলেন, “অতএব খ্রীষ্টের দেহ দ্বারা ব্যবস্থা সম্বন্ধে তোমাদের মৃত্যু হইয়াছে যেন তোমরা অন্যের হও . . . কারণ আমরা ব্যবস্থা হইতে মুক্ত হইয়াছি” (রোমীয় ৭:১-৬ পদ)। পৌলের যুক্তি হলো এই : স্বামী যতদিন জীবিত থাকে তার স্ত্রী ততদিন ব্যবস্থা বা বিধান দ্বারা তার কাছে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী তার ব্যবস্থা বা কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। অনুরূপভাবে খ্রীষ্টিয়ান যে আমরা যার কাছে আমরা আবদ্ধ ছিলাম, খ্রীষ্টের মৃত্যুতে তারও যখন মৃত্যু হয়েছে (কলসীয় ২:১৪ পদ) তখন আমাদের সেই স্বামী স্বরূপ ব্যবস্থা বা বিধানের অধীনতা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। মুক্ত হয়েছি বলেই আমরা স্বাধীন। আর সেই স্বাধীনা রূপে খ্রীষ্টের সঙ্গে বিবাহিতা হলাম (“অন্যের” হলাম)। আর সেই থেকেই তাঁর কাছেই আবদ্ধ রয়েছি (১করিন্থীয় ৭:৩৯ পদ)। সুতরাং পূর্বকালীন ব্যবস্থা নয় কিন্তু খ্রীষ্টের ব্যবস্থাই (১করিন্থীয় ৯:২১ পদ) খ্রীষ্টিয়ানদের পালন করা কর্তব্য।

পৌলের আর একটি যুক্তি আমরা শুনি। তিনি বলেন : “কাল সম্পূর্ণ হইলে ঈশ্বর আপন পুত্রকে প্রেরণ করিলেন; তিনি ব্যবস্থার অধীন জাত হইলেন, যেন তিনি ব্যবস্থার অধীন লোকদের মুক্ত করেন, যেন আমরা দত্তক পুত্রত্ত্ব প্রাপ্ত হই। আর তোমরা পুত্র . . . আর দান নও” (গালাতীয় ৪:৪-৭ পদ) কেউ দু’জন মনিবের সেবা করতে পারে না। পূর্বে মানবজাতি মনিব স্বরূপ ব্যবস্থার অধীনে থেকে তার সেবা করত কিন্তু এখন খ্রীষ্টেতে বিশ্বাসীরা সেই কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে খ্রীষ্টের সেবা করছে।

২। যীশু খ্র্রীষ্টের শিক্ষা।

খ্রীষ্টিয়ানরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে যীশু খ্রীষ্টের শিক্ষাই শেষ্ঠ শিক্ষা। তাঁর শিক্ষার চেয়ে বড় আর কোনো শিক্ষা নাই। এই যাদের মত, ব্যবস্থা পালন সম্বন্ধে তাদের কোনো সমস্যাই থাকে না। কারণ যীশুর সিদ্ধান্তই চরম সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত তারা কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না। এবার আমরা এ সম্বেন্ধে প্রভু যীশুর নিজের কথা শুনি। তিনি বলেন : “ব্যবস্থা যোহন পর্যন্ত; সেই অবধি ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার হইতেছে” (লূক ১৬:১৬ পদ)। আরও স্পষ্টভাবে তিনি বলেন : “সমস্ত ব্যবস্থা যোহন পর্যন্ত ভাববাণী বলিয়াছে” (মার্ক ১১:১২,১৩ পদ)।

যিনি খ্রীষ্টিয় মণ্ডলীর মস্তক (কলসীয় ১:১৮ পদ) তিনিই যখন বিধানের যুগ ও ঈশ্বরের অনুগ্রহের যুগের মধ্যে সীমা নির্দেশ করেছেন, তখন খ্রীষ্টে বিশ্বাসীদের উচিৎ তা মেনে নেওয়া। খ্রীষ্টের বক্তব্য হলো ব্যবস্থার আমল ছিল আবগাহক যোহন পর্যন্ত। তাঁর পরে নয়। এই সিদ্ধান্ত আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। যীশুর চরম প্রভুত্বই প্রমাণ করে দিয়েছে যে ব্যবস্থা বা বিধান বাতিল হয়ে গিয়েছে। যেহেতু বিশ্রামবার পালনও ব্যবস্থা বা বিধানের মধ্যেই বিধত, সেই হেতু বিধানের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্রামবার পালনও বাতিল হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়
চারটি ভ্রান্ত শিক্ষা

১। পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভ ব্যবস্থার দ্বারাই সম্ভব

মিসেস এলেন জি হোয়াইট (Mrs Ellen G, White) তাঁর লিখিত পুস্তকের ৪০৫ ও ৪২২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট ছাড়া অন্য সব খ্রীষ্টিয় ম-লী “ভূতগ্রস্ত” এবং তারা রবিবারকে বিশ্রামবাররূপে পালন করে বলেই শয়তান তাদের দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে বন্দী করে রাখবে, তাদের ধ্বংশও করে দেবে (৪২৬, ৪২৭)। এর মধ্যে যীশু স্বয়ং স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী ১,৪৪,০০০ সপ্তমদিন পালনকারী বা সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-কে তাঁর সঙ্গে স্বর্গে নিয়ে যাবেন। কারণ তারাই শুধু স্বর্গের অধিকারী ও পরিত্রাণপ্রাপ্ত লোক।

সব্রাগ্রে আমাদের লক্ষ করা উচিৎ যে সেই ১,৪৪,০০০ নরনারীর সবাই যিহূদী, পরজাতীয় লোক নয়। প্রকাশিত ৭:৪ পদে লেখা আছে : ইস্রায়েল সন্তানদের সমস্ত বংশের এক লক্ষ চুয়াল্লিশ সহস্র লোক মুদ্রাঙ্কিত।” তারপরে সেই সমস্ত বংশের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে (৫ থেকে ৮ পদ) সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা প্রায় সকলেই পরজাতীয় লোক, তারা যিহূদী জাতির অন্তর্ভূক্ত বলে পরিগণিত হতে পারে না।

আরও লক্ষ করার বিষয় এই যে কেউ যদি খ্রীষ্টিয় বিশ্বাসীও হয় তবুও রবিবারকে বিশ্রামবাররূপে পালন করার অপরাধে সেই হতভ্যাগ্য স্বর্গে যেতে পারে না। পক্ষান্তরে এই কথাই বলা হচ্ছে যে খ্রীষ্টিয়ানদের বিশ্বাস কার্যকরী নহে, আর বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই। আর খ্রীষ্টে বিশ্বাসী হলেও সে পরিত্রাণ পাবে না ও স্বর্গের অধিকারী হবে না। এতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে বিশ্রামবার (শনিবার) পালন দ্বারাই পরিত্রাণ লাভ করা যায়, বিশ্বাস দ্বারা নয়। কিন্তু বাইবেলের শিক্ষা ঠিক এর বিপরীত। যথা : 

(ক) “আমাদের মীমাংসা এই যে ব্যবস্থার কার্য ব্যতিরেকে বিশ্বাস দ্বারাই মনুষ্য ধার্মিক গণিত হয়” (রোমীয় ৩:২৮, ৪:৫ পদ)।

(খ) “কেননা অনুগ্রহেই বিশ্বাস দ্বারা তোমরা পরিত্রাণ পাইয়াছ এবং ইহা তোমাদের হইতে হয় না, ঈশ্বরের দান : তাহা কর্মের ফল নয়, যেন কেহ শ্লাঘা না করে” (ইফিষীয় ২:৮ পদ)।

২। পশুর ছাপ 

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের এ শিক্ষা বুঝাতে হলে প্রকাশিত বাক্যের নিম্নলিখিত পদগুলো পাঠ করা দরকার : - ১৩:১৬,১৭; ১৪:৯-১১ পদ। তারা দাবি করে যে রবিবার পালন এই “পশুর ছাপ বা চিহ্ন (মিসেস্ হোয়াইট এই বই ৬০৫ পৃ:) এবং যারা এই পশুর দাগপ্রাপ্ত তারা নরকেই যাবে (১৯:২০ পদ)। কিন্তু যারা ঐ পশুর দাগ পায়নি (অর্থাৎ S.D.A) তারা খ্রীষ্টের সঙ্গে রাজত্ব করবে (২০:৪ পদ)।

এই শিক্ষার মধ্যে অনেক কিছুই কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে। 

ক। বলা হয়েছে রোমান কাথলিক মণ্ডলীর মস্তক যিনি তিনিই সেই “পশু” (মিসেস্ হোয়াইটের বই ৫৪ পৃ:)। রোমান কাথলিক মণ্ডলীর মস্তক, একজন পুরোহিত, যাকে “পোপ” বলা হয়। পোপ আর সেই পশু এক একথা প্রমাণ করা কি সম্ভব? 

প্রথমত: পোপের পদ অলংকৃত করেছেন বহু সংখ্যক ব্যক্তি। তবে তাঁদের মধ্যে কোন্ পোপ সেই “পশু” ছিলেন? নাম উল্লেখ করে কোনো পোপকে সেই পশুরূপে নির্দেশ করতে কেউই সাহস করেনি। দ্বিতীয়ত, লেখা আছে, সেই পশু ঈশ্বরের নিন্দা করিতে মুখ খুলিল, তাঁহার নামের ও তাঁহার তাম্বুর এবং স্বর্গবাসী সকলের নিন্দা করিতে লাগিল, (প্রকাশিত ১৩:৬ পদ) এবং তাহাকে “সমস্ত জাতির উপরে কর্তৃত্ব দত্ত হইল” (৭-১০ পদ)। আজ পর্যন্ত কোনো পোপ প্রকাশ্য ভাবে ঈশ্বরের নিন্দা করেননি এবং সমস্ত জাতির উপর সেই ধরণের কোনো কর্তৃত্ব পাননি। সুতারং পোপ কোনো অবস্থায় সেই পশু হতে পারে না।

খ। রবিবার পালনই সেই পশুর দাগ, এই দ্বিতীয় বক্তব্য প্রমাণ করা আরও দুরূহ ব্যাপার কারণ শাস্ত্রের কথা অনুসারে এই “পশুর ছাপটি” মানুষের কপালে ও হাতেই দৃষ্ট হবে। তাতে বুঝা যায় যে এই ছাপটা একপ্রকার বাহ্যিক চিহ্ন। কপালে ও হাতে কোনো ধরণের বাহ্যিক চিহ্ন এবং কোনো একটা বিশেষ দিনকে বিশ্রামবার রূপে পালন -- এই দুটি বিষয় কোন্ অর্থে সমতুল্য, তা আমাদের জ্ঞান বুদ্ধির অতীত। মনে রাখা দরকার যে এই বিষয়টিকে ভবিষ্যতের বিষয় বলে ব্যাখ্যা করলে চলবে না, কারণ সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা বলেন তাদের ম-লী ছাড়া আর অন্যান্য সব খ্রীষ্টিয় মণ্ডলীভুক্ত নর-নারীরা নরকের পথের যাত্রী। 

গ। সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা আরও বলেন যে যারা রবিবারকে বিশ্রামবার বলে পালন করে (অর্থাৎ সেই পশুর ছাপ বহনকারী লোক) তাদের লক্ষ করে লিখিত একটি বিশেষ পদ বাইবেলে পাওয়া যায়। পদটি এই : “যে পশুর ছাপ অর্থাৎ নাম কিংবা নামের সংখ্যা যে কেউ ধারণ না করে তাহার ক্রয় বিক্রয় করিবার অধিকার বদ্ধ” (প্রকাশিত বাক্য ১৩:১৭ পদ)। এই পদ সম্বন্ধে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা বলে থাকে যে রবিবার খ্রীষ্টিয়ানেরা তাদের দোকান বন্ধ রাখে, তাই উক্ত পদটি তাদের উপর প্রযোজ্য।

বলা বাহুল্য, এই পদটি কোনো ক্রমেই খ্রীষ্টিয় ম-লী সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয় এবং এই কথা যদি কোনো সম্প্রদায়ের ঘাড়ে চাপাতে হয় তাহলে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের ঘাড়ে চাপাবার যুক্তি-সঙ্গত কারণ আছে। কারণ তারাই আক্ষরিকভাবে সেই পদটিকে মানে।

৩। অনুসন্ধান ও বিচার (মিসস্ হোয়াইটের পুস্তক ৪২৫ পৃঃ) 

আমাদের প্রভু-যীশু খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আগমন সম্বন্ধে জেমস্ হোয়াইট সাহেব ও তাঁর স্ত্রী তিনবার ভবিষ্যৎদ্বাণী করেছিলেন। প্রভু যীশু খ্রীষ্ট তাঁর মনোনীতদের নিয়ে যাবার জন্য ১৮৪৩ সালে আসছেন একথা তাঁরা প্রথমে প্রচার করলেন। পরে ১৮৪৪ ও ১৮৪৫ সালে ঠিক একই মাসের নাম উল্লেখ করে তারা অনুরূপ প্রচার করলেন। তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে অনেকে তাদের স্থাবর অস্থাবর বিষয় সম্পত্তি বিক্রয় করে যীশুকে অভ্যর্থনা করার জন্য ও তাঁর সঙ্গে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো! কিন্তু তিনবারই তাদের আশা বিফল হলো। জেমস্ হোয়াইট সাহেব তাঁর ভুল সরলভাবে স্বীকার করলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী বললেন, ভুল প্রকৃতপক্ষে হয়নি, মাত্র অংকের ভুল হয়েছে! ১৮৪৪ সালের ভাদ্র মাসে যীশু এ জগতে ফিরে না এস স্বর্গের “সবচেয়ে পবিত্র স্থানে প্রবেশ করলেন” এবং সেখানে গিয়ে প্রত্যেক খ্রীষ্টিয়ানের “পাপের তালিকা” অনুসন্ধান করতে লাগলেন। যীশুর সেই অনুসন্ধান কার্য এখনও চলছে, অনুসন্ধান শেষ হলে যীশু এ জগতে ফিরে আসবেন। আর বিশ্বাসী অর্থাৎ খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্যে কে স্বর্গে যাবার যোগ্য তখন এ বিষয়ে (সেই অনুসন্ধান ও বিচার ফল) জানানো হবে। মিসেস্ জে হোয়াইট আরও বলেছেন, “যারা তাদের পাপের জন্য অনুতাপ করে ক্ষমা চায়নি, তাদের ক্ষমা করা হবে না ও ঈশ্বরের ‘স্মরণার্থক পুস্তক থেকে তাদের নাম মুছে ফেলা হবে” (৪৮৩ পৃঃ)।

উপরে বর্ণিত শিক্ষার সঙ্গে বাইবেলে প্রদত্ত শিক্ষার কোথাও কোনো মিল নেই কারণ :

ক। আমাদের মুক্তিদাতা নিজেই বলেন যে তাঁর আগমনের তারিখ কেউই জানে না, জানতে পারেও না (মথি ২৪:৩৬ পদ)। এ কথা বলা সত্বেও সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-এর নেতৃবর্গ তিনবার যীশুর আগমনের তারিখ ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তিনবার তাদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা বলে প্রামাণিত হয়েছে।

খ। শাস্ত্র বলে যে স্বর্গারোহণের পর প্রভু যীশু স্বর্গে গৃহীত হলেন এবং “ঈশ্বরের দক্ষিণে বসিলেন”। (মার্ক ১৬:১৯ পদ)। এর চেয়ে পবিত্র স্থান কোথায় আর আছে কি? “সবচেয়ে পবিত্র স্থান” - এমন কথা নতুন নিয়মে নেই। যীশুর আগমনের অলীক তারিখ ঘোষণার ভ্রান্তিকে ঢাকবার জন্যই মিসেস্ জে হোয়াইট স্বর্গের “সবচেয়ে পবিত্র স্থান” আবিষ্কার করেছেন।

গ। বিশ্বাসীদের কোনো “পাপের তালিকা” কোথাও আছে এমন কথা বাইবেলে উল্লেখিত হয়নি। যীশু যখন সর্বজ্ঞ এবং সকলই তিনি জানতেন (যোহন ২:২৪ পদ) তখন মানুষের পাপের সংখ্যা এক এক করে গণনা করা তাঁর কি প্রয়োজন আছে? এই ধরণের শিক্ষা দ্বারা সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা যীশুকে মানুষেরই সমতুল্য করে তুলেছে মাত্র। এই ভ্রান্ত শিক্ষা সর্বতোভাবে আগ্রাহ্য হবার যোগ্য। তাছাড়া, মিসেস্ জে হোয়াইটের শিক্ষানুযায়ী কেবল ১,৪৪,০০০ লোক, যারা সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট, তারাই পরিত্রাণ পাবে (এই অধ্যায়ের ১নং অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। কাজেই অন্যান্য খ্রীষ্টিয়ানদের “পাপের তালিকা” অনুসন্ধান করার কোনো প্রয়োজন ত প্রভু যীশুর নেই।

ঘ। প্রত্যেক খ্রীষ্টিয়ানদের বিচার হবে বটে, তবে সেই বিচারে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে নয়। মানুষের দুই ধরণের বিচার হয়। প্রথমটি: পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে বিচার। এই বিচার ইহকালে, মৃত্যুর আগে এ জগতেই হয়ে থাকে। পাপী মানুষ যদি তার পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে যীশু খ্রীষ্টের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে ক্ষমা প্রার্থী হয়, তাহলে সে ক্ষমা পায় ও “আর বিচারে আনীত হয় না, কিন্তু সে (আত্মিক) মৃত্যু হইতে জীবন পার হইয়া গিয়াছে” (যোহন ৫:২৪; ৩:৩৬ পদ)। আবার যীশু বলেন, “আমি তাঁহাদিগকে (তাঁর প্রতি যারা বিশ্বাসী) অনন্ত জীবন দেই; তাহারা কখনই বিনষ্ট হইবে না” (যোহন ১০:২৭,২৮ পদ)। “অতএব এখন যাহারা খ্রীষ্ট যীশুতে আছে, তাহাদের প্রতি কোনো দ-াজ্ঞা নাই” (রোমীয় ৮:১ পদ) 
দ্বিতীয় বিচার খ্রীষ্টিয়ানদের মৃত্যুর পরে পরলোকে। লেখা আছে, আমাদের সকলকেই খ্রীষ্টের বিচারাসনের (গ্রিক ভাষায় বীমা - ‘বীমা’ শব্দটির অর্থ : খেলার মাঠে নির্মিত প্লাটফর্ম বা বেঞ্চ Ñ যার উপর থেকে পুরুষ্কার বিতরণ করা হয়) সম্মুখে প্রত্যক্ষ হইতে হইবে, যেন প্রত্যেক জন আপনার কৃতকার্য অনুসারে দেহ দ্বারা উপার্জিত ফল পায়” (২করিন্থীয় ৫:১০ পদ)। এই পদের সঙ্গে ১করিন্থীয় ৩:১০-১৫ পাঠ করুন। লক্ষ্য করুন, “যাহার কর্ম পুড়িয়া যায়, সে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, কিন্তু সে আপনি পরিত্রাণ পাইবে” (১৫ পদ)। পরিত্রাণের জন্য নয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক পুরুষ্কার পাবার উদ্দেশ্যেই খ্রীষ্টিয়ানদের বিচার হবে। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, ১২ থেকে ১৫ পদ পর্যন্ত “কর্ম” শব্দটি চারবার উল্লেখিত হয়েছে। ইহকালে, দেহধারী অবস্থায়, ঈশ্বর বা যীশু বা পবিত্র আত্মার উদ্দেশ্যে খ্রীষ্টিয়ানরা যে সমস্ত কাজ করে সেই সকল কাজ যীশুর অগ্নিরূপ বিচার ব্যক্ত হবে এবং খ্রীষ্টিয়ানরা পুরুষ্কার স্বরূপ “স্বর্ণ, রৌপ্য ও বহুমূল্য প্রস্তর স্বরূপ” পরিগণিত হবে।

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের এই অনুসন্ধান ও বিচার বিষয়ক শিক্ষা বাইবেল ভিত্তিক নয়, কাজেই এই শিক্ষাকে ভ্রান্ত ও আজগুবি বলেই আমরা অগ্রাহ্য করছি।

৪। খ্রীষ্টের দ্বারা সাধিত প্রায়শ্চিত্তের অঙ্গীকার।

তাঁর পুস্তকের ৬৫৮, ৬৭৩ পৃষ্ঠায় মিসেস্ এলেন জি হোয়াইট লিখেছেন, “বিচারের পর ঈশ্বর মানবজাতির সমগ্র পাপ শয়তানের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকেই যন্ত্রণাগারে পাঠাবেন।”

কিন্তু বাইবেলের কোথাও এই ধরনের কথা পাওয়া যায় না। ঈশ্বরের সম্মুখ থেকে শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে, একথা লেখা আছে কিন্তু সমস্ত মানবজাতির পাপ শয়তানের উপর চাপিয়ে দেবেন, এমন কথা তো বাইবেলের কোথাও লেখা নেই। সুসমাচার লেখক যোহন বলেন, “ঐ দেখ, ঈশ্বরের মেষ শাবক, যিনি জগতের পাপভার লইয়া যান” (১:১৯ পদ)। সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের শিক্ষা অনুযায়ী, শয়তানই মানুষের পাপের ভার নিয়ে যাবে, যীশু সে কাজ করেননি। তাহলে এদের শিক্ষা অনুসারে শয়তানই মানুষের পাপের জন্য প্রায়শ্চ্ত্তি সাধন করেছে এবং পাপীদের পরিত্রাণ করেছে। এর দ্বারা প্রাকারান্তরে ক্রুশের উপর যীশুর সাধিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত কার্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। খ্রীষ্ট ধর্মের মূল বিশ্বাসকেই যারা অগ্রাহ্য করে সেই সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের ভ্রান্ত শিক্ষাকে আমরা কিছুতেই গ্রাহ্য করতে পারি না।

         চতুর্থ অধ্যায়নতুন নিয়মের বিভিন্ন পদের আলোচনা

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের নানা পদ তাদের আপন ধর্মমত অনুসারে ব্যাখ্যা করে থাকে। সেই মনগড়া ব্যাখ্যার উপরই এদের ধর্ম বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত। বাইবেলের বিভিন্ন পদের যে ব্যাখ্যা সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা দিয়ে থাকে, অন্য সমস্ত খ্রীষ্টিয় সম্প্রদায়ের প্রদত্ত ব্যাখ্যার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। আমাদের শাস্ত্রের শিক্ষানুযায়ী এই সমস্ত পদের প্রকৃত ব্যাখ্যা কী তা আমাদের জানা প্রয়োজন। প্রকৃত সত্য জানার জন্য পবিত্র আত্মার পরিচালনার উপর নির্ভর করে আমরা এখানে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের দ্বারা উদ্ধৃত কয়েকটি প্রধান প্রধান পদের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আলোচনা করব। অবশ্য একথা সত্য যে এরা বাইবেলের যে সমস্ত পদ উদ্ধৃত করে নিজেদের মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদান করে এই ক্ষুদ্র পুস্তিকার মধ্যে সেই সব কয়টি পদের আলোচনা সম্ভব নয়।

১। যীশু “আপন রীতি অনুসারে বিশ্রামবারে সমাজ গৃহে প্রবেশ করিলেন ও পাঠ করিতে দাঁড়াইলেন” (লূক ৪:১৬ পদ)। এই পদে প্রমাণিত হয় যে যীশু স্বয়ং বিশ্রামবার পালন করতেন। কাজেই আমাদেরও এই দিনটি পালন করা উচিৎ।

উত্তর : যীশু যিহুদী ছিলেন বলেই তিনি ব্যবস্থার সমস্ত প্রয়োজনীয় বিধান পালন করতে বাধ্য ছিলেন যাতে ব্যবস্থা তিনি পূর্ণ-করেন (মথি ৫:১৭ পদ), নতুবা তিনি অপরাধী হতেন। “তিনি ব্যবস্থার অধীন জাত হইলেন যেন তিনি ব্যবস্থার অধীন লোকদের মুক্ত করেন” (গালাতীয় ৪:৫ পদ)।

ব্যবস্থা থেকে যারা মুক্ত তারা ব্যবস্থার অধীন নয়, সুতরাং ব্যবস্থা তাদের পালনীয় নয়। আর যেহেতু বিশ্রামবার পালন ব্যবস্থারই অঙ্গ সেহেতু এই দিনটিও তাদের পালনীয় নয়।

২। “তোমরা যদি আমাকে প্রেম কর, তবে আমার আজ্ঞা সকল পালন করিবে” (যোহন ১৪:১৫ পদ)

উত্তর : (১) যীশুর “আজ্ঞা সকল” বলতে কী বুঝায় এবং তাঁর কথার নিহীত অর্থ কী এ বিষয়ে আমাদের স্থির সিদ্ধান্তে আসা দরকার। যীশু বলেছিলেন, “নতুন আজ্ঞা আমি তোমাদের দিতেছি, তোমরা পরষ্পর প্রেম কর, তাহাতে সকলে জানিবে যে তোমরা আমার শিষ্য” (যোহন ১৩:৩৪,৩৫ পদ)। এই পদের সঙ্গে সাধু পৌলের কথা পাঠ করতে হবে। তিনি লিখেছেন, “প্রেমই ব্যবস্থার পূর্ণসাধন” (রোমীয় ১৩:১০ পদ)।

“নতুন আজ্ঞা” এ কথার দ্বারা যীশু বলেন যে পুরাতন আজ্ঞার স্থানে নতুন কিছু দেওয়া হয়েছে। আর তাঁর সেই নতুন আজ্ঞার অর্থ হলো এই যে ব্যহ্যিক কোনো রীতিনীতি পালন করে নয়, অন্তরের প্রকৃত প্রেমের দ্বারাই ব্যবস্থার পূর্ণতা সাধিত হয়। বিশ্রামবার পালন একটি বাহ্যিক ক্রিয়া মাত্র যা নিখুঁতভাবে পালন করলেও যীশুর সেই নতুন আজ্ঞা পালন করা হয় না। অপর পক্ষে ঈশ্বর ও মানুষের প্রতি প্রেম যদি খ্রীষ্টিয়ানদের হৃদয়ে পরিপূর্ণ থাকে তাহলে বিশ্রামবার পালন না করলেও সে যীশুর আজ্ঞাই পালন করে। এটাই যথেষ্ট, এর চেয়ে বেশী কিছু ঈশ্বরও চান না।

উত্তর : (২) যীশু তাঁর শিষ্যদের বা খ্রীষ্টিয় ম-লীকে বিশ্রামবার পালন সম্বন্ধে কোনই আজ্ঞা দেননি। কাজেই বিশ্রামবার যারা পালন করে না, তারা যীশুর “আজ্ঞা সকলের” মধ্যে কোনটিই অমান্য করে না।

(৩) “মনে করিও না যে আমি ব্যবস্থা কি ভাববাদী গ্রন্থ লোপ করিতে আসিয়াছি, আমি লোপ করিতে আসি নাই, কিন্তু পূর্ণ করিতে আসিয়াছি . . . “যে পর্যন্ত আকাশ ও পৃথিবী লুপ্ত না হইবে সে পর্যন্ত ব্যবস্থার একমাত্রা কি বিন্দু লুপ্ত হইবে না” (মথি ৫:১৭, ১৮ পদ)। এই শাস্ত্র পদ অনুসারে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা দাবি করে যে যীশুর উল্লিখিত কথানুযায়ী ব্যবস্থা বা বিধান অটল ও চিরস্থায়ী; আর বিশ্রামবার পালন যেহেতু সেই ব্যবস্থারই একটা অংশ স্বরূপ, সেহেতু সেই দিনটি পালনও একটি অটল ও চিরস্থায়ী বিষয়। আর এই কারণে সকলেরই বিশ্রামবার পালন অবশ্য কর্তব্য। 

উত্তর : (১) ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে যীশুর প্রভুত্ব আমরা সম্পূর্ণরূপে মানি, তাঁর কথার উপর অন্য কারও কোনো কথা বলার অধিকার নেই। আর কেউ যদি সেই দুঃসাহস করেও তাহলে সেই ব্যক্তির কথাকে অগ্রাহ্যই করতে হবে।

বাইবেলের উল্লিখিত পদটিতে প্রভু যীশু বলেছেন যে তিনি ব্যবস্থা লোপ করতে আসেননি। কিন্তু সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা নিজেরাই বলে যে যীশু “মোশির ব্যবস্থা” লোপ করেছেন, (প্রথম অধ্যায় ২নং অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। কাজেই তাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যখন মোশির ব্যবস্থা রহিত হয়েছে, তখন এই ব্যবস্থাকে কীভাবে আর “অটল ও চিরস্থায়ী” বলা যায়?

সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা একদিকে বলে যীশু ব্যবস্থা লোপ করতে আসেননি, অন্যদিকে তারা বলে যে যীশু মোশির ব্যবস্থা লোপ করেছেন। যীশু যদি মোশির ব্যবস্থা বতিল করে দিয়ে থাকেন তাহলে সেই ব্যবস্থা কোনো ক্রমেই অটল বা চিরস্থায়ী হতে পারে না।

উত্তর : (২) যীশু ব্যবস্থা পূর্ণ করতে এসেছেন - এ কথার অর্থ কী? এর অর্থ হলো ব্যবস্থাকে তার প্রকৃত অর্থে পূর্ণ করতেই যীশু এসেছিলেন। ধর্মীয় নেতারা নানা ধরণের অর্থ করে বিভিন্নভাবে ব্যবস্থার ব্যাখ্যা করত সেই ব্যাখ্যা অনুসারে জীবনযাপন করার জন্য জনসাধারণকে শিক্ষা দিত। কিন্তু প্রভু যীশু ব্যবস্থার অন্তনিহিত অর্থ উদঘাটিত করে ব্যবস্থার বাস্তব ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করতেন। উপরোক্ত দুটি উদ্ধৃত পদের ঠিক পরেই কোন্ অর্থে তিনি ব্যবস্থা পূর্ণ করতে এসেছিলেন যীশু ছয়টি উদাহরণ দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যথা :

(ক) নরহত্যা সম্বন্ধে তিনি বলেন, যে আপন ভ্রাতার প্রতি ক্রোধ করে সে আধ্যাত্মিক অর্থে নরহত্যা করে - মথি ৫:২১,২২ পদ।

(খ) ব্যভিচার সম্বন্ধে তিনি বলেন, “যে কেউ কেনো স্ত্রীলোকের প্রতি কামভাব দৃষ্টিপাত করে, সে তখনই মনে মনে তার সঙ্গে ব্যভিচার করলে” (২৭ পদ)

(গ) স্ত্রী পরিত্যাগ সম্বন্ধে ৩১ পদ; (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ পদ)

(ঘ) দিব্য করা সম্বন্ধে - ৩৩ পদ

(ঙ) প্রতিশোধ সম্বন্ধে - ৩৭ পদ (যাত্রাপুস্তক ২১:২৪ পদ)

(চ) প্রেম ও দ্বেষ সম্বন্ধে - ৪৩ (লেবীয় ১৯:১৮ পদ)

উল্লেখিত ছয়টি উদাহরণ সম্বন্ধে, “কিন্তু আমি তোমাদিগকে কহিতেছি” এই কথা বলে যীশু ব্যবস্থার উপর যে তাঁর পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে সেই সত্যকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই ৬টি উদাহরণের মধ্যে দিয়ে ব্যবস্থার প্রকৃত উদঘাটন করে যীশু ব্যবস্থাটিকে তার ঐশ্বরিক অর্থে পরিপূর্ণ করলেন। মথি ৫:২২, ২৮, ৩২, ৩৪, ৩৯ ও ৪৪ পদ দ্রষ্টব্য।

উত্তর : (৩) বিধান লোপ করা সম্বন্ধে যীশুর কথা আমাদের সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা দরকার। আকাশ ও পৃথিবী লুপ্ত হলে পর ব্যবস্থাও লোপ পাবে একথা যীশু বলেননি। তিনি কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ব্যবস্থার “সমস্তই সফল হবে” (১৮); এর পরেই ব্যবস্থা লোপ পাবে। ব্যবস্থা কীভাবে পূর্ণ হলো, আগের আলোচনায় তা দেখানো হয়েছে। যীশু স্বয়ং বিধান পূর্ণ করেছেন। তার পরেই তিনি সেই ব্যবস্থাকে লোপ বা বাতিল করে দিলেন। (দ্বিতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য) লূক লিখিত সুসমাচারে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে : “কিন্তু ব্যবস্থার এক বিন্দু পড়িয়া যাওয়া অপেক্ষা বরং আকাশ ও পৃথিবী লোপ হওয়া সহজ” (১৬:১৭ পদ)। আমাদের মতে পদটির প্রকৃত ব্যাখ্যা এই : বিধান যে যুগান্ত পর্যন্ত স্থায়ী হবেই, তা নয়। বরং বিধানের সমস্ত দাবিই যে নিশ্চিতভাবে পূর্ণ হবে, যীশু এই কথাই বলতে চেয়েছেন। এই পদে বিধানের স্থায়ীত্বের কথা নয় কিন্তু তার সফলতার নিশ্চয়তার কথাই বলা হয়েছে।

উত্তর : (৪) সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা মথি ৫:১৭,১৮ পদ নিজেদের মনোমত করে ব্যাখ্যা করে শ্রোতাদের বুঝিয়ে দেয় যে যীশু বিশ্রামবার পালন সম্বন্ধীয় সেই চতুর্থ আজ্ঞার ওপর জোর দিচ্ছেন। এই পদের নির্ভুল ব্যখ্যা করতে হলে কিছুটা গ্রিক ভাষা জানা প্রয়োজন। এই দুই পদে ব্যবস্থা বা বিধান শব্দটি যেখানে পাওয়া যায় সেখানে গ্রিক ভাষায় ‘হো নমস্’ শব্দটি দৃষ্ট হয়। ‘হো নমস্’-এই গ্রিক কথাটির অর্থ হলো “সম্পূর্ণ ব্যবস্থা”। কাজেই আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি :

(ক) যীশু বিধানকে তার প্রকৃত আধ্যাত্মিক অর্থে পূর্ণ করলেন এবং বিধানের নানা রীতিনীতি বা বিধিব্যবস্থা পালন করে বিধানের সমস্ত দাবি পূর্ণ করে দিলেন। এ অর্থেও তিনি বিধান পূর্ণ করলেন। এরপরেই যেহেতু ব্যবস্থার “সমস্তই সফল” হয়েছিল, সেহেতু তিনি “প্রথম বিষয় (ব্যবস্থা) লোপ করেন” (ইব্রীয় ১০:১০ পদ)। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সাধু পৌলের শিক্ষা দ্রষ্টব্য।

৪। প্রভু যীশুকে সমাধি দেয়ার পর, কয়েক জন নারী সম্বন্ধে শাস্ত্রে লেখা হয়েছে - “পরে ফিরিয়া গিয়া . . . বিশ্রামবারে তাহারা বিধিমতে বিশ্রাম করিলেন” - (লূক ২৩:৫৬ পদ)। এই পদের উল্লেখই প্রমাণ করে যে যীশুর মৃত্যুর পরেও বিশ্রামবার পালন করা হয়েছে : কাজেই সেই দিনটি আমাদের পালন করা কর্তব্য।

উত্তর : (১) যীশুর মৃত্যুর পর সেই নারীরা বিশ্রামবার পালন করেছিল বটে, কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, সেই বিশ্রামবার ছিল যীশুর পুনরুত্থানের আগে। শনিবার তারা বিশ্রাম গ্রহণ করেছিল, আর যীশু সমাধি থেকে পুনরুত্থিত হলেন রবিবারে। যীশুর পুনরুত্থান সম্বন্ধে এই নারীরা কিছুই জানত না এবং সেই ঘটনার ফলে কী যে মহাপরিবর্তন হবে সে সম্বন্ধেও তারা ছিল একেবারে অজ্ঞ। যীশু খ্রীষ্টের পুনরুত্থান দিনের স্মরণে খ্রীষ্টিয়ানেরা রবিবারকে প্রভুর দিন বলে পালন করে (প্রকাশিত বাক্য ১:১০ পদ)।

উত্তর : (২) এই নারীরা পঞ্চশত্তমীর দিনও পালন করেছিল (প্রেরিত ১:১৪ ও ২:৬ পদ)। তারা যখন বিশ্রামবার পালন করেছিল, খ্রীষ্টিয়ানদেরও সেই বিশ্রামবার পালন করা উচিত - এই যুক্তি অনুসারে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দেরও পঞ্চশত্তমীর দিনটি পালন করা উচিত। কিন্তু তারা সেই নির্দিষ্ট দিনে এই দিনটি পালন করে না এবং সেভাবেও পালন করে না। কাজেই তাদের যুক্তি অর্থহীন, অসংগত। তাই গ্রহণ যোগ্য নয়।

৫। ধনী যুবকের একটি প্রশ্নের উত্তরে যীশু বলেন - “তুমি যদি জীবনে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা কর হবে আজ্ঞা সকল পালন কর” (মথি ১৯:১৭ পদ)। এই পদ উল্লেখ করে সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা দাবি করে এখানে যীশু নিজেই বলেছেন যে সকল আজ্ঞা পালন করা আবশ্যক’ আর যেহেতু বিশ্রামবার পালন ঈশ্বরেরই অন্যতম আজ্ঞা, সেহেতু তা পালন করতে হবে।

উত্তর : ধনী যুবক : “আজ্ঞা সকল পালন” সম্বন্ধে যীশুকে আরও প্রশ্ন করেছিল - “কোন্ কোন্ আজ্ঞা” তাকে পালন করতে হবে। এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যীশু কয়েকটি প্রধান আজ্ঞার নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এদের মধ্যে বিশ্রামবার পালনের কথার উল্লেখ মাত্র ছিল না (১৮,১৯ পদ)। যীশু স্বয়ংই বিশ্রামবার পালককে নির্দিষ্ট আজ্ঞা থেকে বাদ দিয়েছেন। এতেই প্রামণিত যে চতুর্থ আজ্ঞা পালনকে আমাদের জীবনের অঙ্গীভূত করার কোনো কারণ সেই এবং সেই কারণে বিশ্রামবার পালন অনাবশ্যক।

৬। সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-রা বলে, নতুন নিয়মে ৫৯ বার “বিশ্রামবার” কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা সেই দিনটির মহত্তম তাৎপর্য প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই পরোক্ষে এই দিনটি পালন করার জন্যই বলা হয়েছে।

উত্তর : নতুন নিয়মে “সমাজ গৃহ” শব্দটি ১১৫ বার উল্লেখিত হয়েছে। কাজেই সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের যুক্তি অনুসারে সমাজগৃহের মহত্তম তাৎপর্যও প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের উচিত তাদের সমস্ত গীর্জাঘর ভেঙ্গে দেওয়া এবং সেগুলোর জায়গায় যিহুদীদের সমাজগৃহ নির্মাণ করা। নতুন নিয়মে “হোমবলি” ৩৮বার উল্লেখিত হয়েছে এবং “নিস্তার পর্ব” হয়েছে ২৮বার। কোনো একটি রীতি পালনের মহত্ব যদি তার উল্লেখ সংখ্যার উপর নির্ভর করে তাহলে “হোমবলি” এবং “নিস্তার পর্ব”-কেও সেভেন্থ-ডে এ্যড্ভেন্টিস্ট-দের পালন করা উচিত। এই দায়িত্ব এড়াবার জন্য তারা দুই প্রকার ব্যবস্থার কথা বলে থাকে। প্রথম অধ্যায়ের ২ অনুচ্ছেদ দেখুন। বাইবেলে কিংবা নতুন নিয়মে কোনো একটি বিষয় কয়বার উল্লিখিত হয়েছে তার উপরেই সেই বিষয়ের গুরুত্ব বা মহত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না, বরং সেই বিষয় সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তার উপরই সেই বিষয়ের মহত্ব বা গুরুত্ব নির্ভর করে।

৭। আদি যুগের খ্রীষ্টিয়ানেরা যিহুদীয় বিশ্রামবার (শনিবার) পালন করত। সুতরাং তাদের মত আমাদেরও সেই দিনটি পালন করা কর্তব্য। এ যুগের খ্রীষ্টিয়ানদের অনেকে ভ্রান্তি বশতঃ রবিবারকে বিশ্রামবাররূপে পালন করে পাপ করে।

উত্তর : (১) আদিযুগের খ্রীষ্টিয়ানেরা যিহুদীয় বিশ্রামবার পালন করত ও সেই দিনে বিশ্রামবার পালন করত একথা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু মনে রাখতে হবে আদি খ্রীষ্টিয়ানরা যিহুদী ধর্মাবলম্বী ছিল এবং যিহুদী ব্যবস্থা বা বিধান অনুযায়ী ক্রিয়া কার্য রীতিনীতি ও নানাবিধ বিধি তারা স্বাভাবিক ভাবেই পালন করত। জীবনের শুরু থেকে মানুষ যা বিশ্বাস ও অভ্যাস করে তার সবকিছু এক দিনে পরিত্যাগ করা যায না। তাই যিহুদী ধর্ম থেকে যারা খ্রীষ্টেতে বিশ্বাসী হয়ে উঠল তারা একদিনেই তাদের পুরাতন ধর্মীয় প্রথা পরিত্যাগ করতে পারেনি। কিন্তু তাদের মন যেমন ক্রমে ক্রমে খ্রীষ্টধর্মের আলোকে আলোকিত হতে থাকল, তারা তাদের আগেকার ধর্মের ভ্রান্ত ক্রিয়া পদ্ধতি পরিত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে এই ধর্মেরই ক্রিয়া কার্য পালন করতে লাগল। যিহুদী ধর্মের প্রথা অনুযায়ী হাত-পা ধোয়ান বিভিন্ন পর্ব ও অমাবস্যা পালন এমনকি ব্যবস্থা বা বিধানও পরিত্যাগ করে আদি যুগের খ্রীষ্টিয়ানরা খ্রীষ্টেতে বিশ্বাস, অবগাহন, “প্রভুর দিন” ও “প্রভুর ভোজ” ইত্যাদি খ্রীষ্টধর্ম অনুসৃত বিষয় পালন করতে শুরু করল। তাদের ধর্মমতের পরিবর্তন হলো এইরূপ : যিহোভা নামক ঈশ্বরের পরিবর্তে পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মাকে তারা গ্রহণ করল ব্যবস্থা পালনের স্থানে এল মুক্তিদাতা যীশুর ওপর নির্ভরতা, বিশ্রামবার পালনের স্থানে প্রভুর দিনে উপাসনা এবং নিস্তার পর্বের পরিবর্তে এল প্রভুরভোজ। “কারণ আমাদের নিস্তার পর্বীয় মেষশাবক বলিকৃত হয়েছে, তিনি খ্রীষ্ট“ (১করিন্থীয় ৫:৭ পদ।) 

উত্তর : (২) পুনরুত্থানের পর কোনো যিহুদীয় বিশ্রামবারে যীশু তাঁর শিষ্যদের দেখা দিননি Ñ একবারও না। এতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, পুনরুত্থানের পর যীশু বিশ্রামবার পালন করেননি। জিজ্ঞাসা করি কেন? উত্তরে বলি - বিধান বাতিল হয়েছে সেই সঙ্গে সঙ্গে শনিবারকে বিশ্রামবাররূপে পালনও বাতিল হয়ে গিয়েছে। সুতরাং বর্তমান যুগে যে সমস্ত খ্রীষ্টিয়ান বিশ্রামবার পালন করে না, তারা পুনরুত্থিত যীশুকেই অনুসরণ করেন এবং সেই বিষয়ে কোনো পাপ করে না। আবার পরিস্কার করে বলে দিই কোনো খ্রীষ্টিয়ানই রবিবারকে বিশ্রামবাররূপে পালন করে না। (প্রথম অধ্যায়ের ৩ (৩) দ্রষ্টব্য)। এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় যে শনিবার বা সপ্তমদিনকে বিশ্রামবাররূপে পালনের আজ্ঞা খ্রীষ্টিয়ানদের দেওয়া হয়নি। নতুন নিয়মে খ্রীষ্টিয়ানদের জন্য এ ধরণের কোনো আজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেক খ্রীষ্টিয়ান বিশেষ “বিশ্রাম” পালন করে। এই বিশ্রাম কী? এই বিশ্রাম হলো সেই বিশ্রাম যা তাঁর অনুগামীদের জন্য যীশু প্রস্তুত করে রেখেছেন শাস্ত্র লেখা আছে - “সুতরাং ঈশ্বরের প্রজাদের নিমিত্ত বিশ্রামকালের ভোগ বাকী রহিয়াছে . . . অতএব আইস, আমরা সেই বিশ্রামবারে প্রবেশ করিতে যতœ করি . . . ” (ইব্রীয় ৪:৮-১১ পদ)। কিন্তু এই শাস্ত্রীয় বাক্যের অর্থ কী ? ঈশ্বর যেমন তাঁর সৃষ্টি কার্য শেষ করে বিশ্রাম করলেন, অনুরূপভাবে যীশুও পাপীদের জন্য প্রায়শ্চিত্ত সাধক কার্য শেষ করে (সেই কার্য থেকে) বিশ্রাম গ্রহণ করলেন (যোহন ১৭:৪ পদ)। খ্রীষ্টেতে যারা বিশ্বাসী তারা (যীশুর সেই সাধিত কার্যের গুণে) খ্রীষ্টেতে আশ্রয় পায় এবং তাঁর সেই বিশ্রামের সহভাগী হয়। যেহেতু যীশু ব্যবস্থার বা বিধানের সমস্ত দাবি মিটিয়ে দিয়েছেন সেই হেতু তাঁর ওপর ব্যবস্থার আর কোনো দাবি থাকতে পারে না। সুতরাং খ্রীষ্টেতে আশ্রিত কোনো খ্রীষ্টিয়ানের ওপরেও ব্যবস্থার আর কোনো দাবি নেই। আধ্যাত্মিক পরিত্রাণের জন্য ব্যবস্থা অনুযায়ী যা করণীয় ছিল, তার সবই যীশু পূর্ণ করে তাঁর “বিশ্রামে প্রবেশ করেছেন।” যীশু খ্রীষ্টের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে যে ব্যক্তি সেও তার বিশ্বাস দ্বারা যীশু খ্রীষ্টের সেই “বিশ্রামকালে” প্রবেশ করেছে। ব্যবস্থা পালন করে নয় কিন্তু কেবলমাত্র যীশুতে বিশ্বাস দ্বারাই বিশ্বাসী খ্রীষ্টের বিশ্রামে প্রবেশ করে। ব্যবস্থা বা বিধান নির্দিষ্ট কার্যের বাধ্যবাধকতা থেকে সে মুক্ত।

“অতএব . . . বিশ্রামবার সম্বন্ধে কেহ তোমাদের বিচার না করুক” (কলসীয় ২:১৬ পদ)। “স্বাধীনতার নিমিত্ত খ্রীষ্ট আমাদিগকে (খ্রীষ্টিয়ানদের) স্বাধীন করিয়াছেন; অতএব তোমরা স্থির থাক, এবং (ব্যবস্থার) দাসত্ব যোঁয়ালিতে আর বদ্ধ হইও না। তোমরা যে সকল লোক ব্যবস্থার দ্বারা ধার্মিক গণিত হইতে যতœ করিয়াছ, তোমাদের খ্রীষ্ট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছ - অনুগ্রহ হইতে পতিত হইয়াছ” (গালাতীয় ৫:১, ৪ পদ)। যারা ব্যবস্থার অধীন থাকতে চায় তারা সেই ব্যবস্থার দ্বারাই দোষী প্রতিপন্ন হবে, যেহেতুক ব্যবস্থার কার্য দ্বারা কোন লোক ঈশ্বরের সাক্ষাতে ধার্মিক গণিত হবে না।” (রোমীয় ৩:১৯-২০ পদ)। এইজন্য ব্যবস্থা পালন করার চেষ্টা করাও বৃথা। আপন আত্মার পরিত্রাণের জন্য কিংবা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ধার্মিক গণিত হবার উদ্দেশ্যে যে কেউ ব্যবস্থা পালনের উপর নির্ভর করে তার জেনে রাখা ভালো যে, তার সমস্ত চেষ্টাই নিরর্থক ও নিষ্ফল হচ্ছে। কারণ লেখা আছে, “অনুগ্রহেই, বিশ্বাস দ্বারা তোমরা পরিত্রাণ পাইয়াছ, এবং এ তোমাদের হইতে হয় নাই, ঈশ্বরের দান ; তা কর্মের ফল নয় যেন কেউ (আত্মা) শ্লাঘা না করে” (ইফিষীয় ২:৮-৯ পদ)। 

এখানে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তবে ব্যবস্থা বা বিধান কেন দেওয়া হয়েছিল? এর উত্তরে শাস্ত্র বলে : “যেন অপরাধের বাহুল্য হয়” (রোমীয় ৫:২০ পদ) এবং সেই হেতু “যেন প্রত্যেক মুখ বন্ধ এবং সমস্ত জগত ঈশ্বরের বিচারের অধীন হয়” (রোমীয় ৩:১৯ পদ)। যেখানে লিখিত আইন নেই সেখানে অপরাধীকে দোষী বলে প্রমাণ করা যায় না; কিন্তু লিখিত আইন, ব্যবস্থা বা বিধান থাকলে অপরাধীকে আইন অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করা সহজ। ব্যবস্থা বা বিধান দেওয়ার পূর্বে যিহুদা জাতি তাদের দোষ অপরাধ অস্বীকার করতে পারত, কিন্তু বিধান দেওয়ার পরে সেই পথ বন্ধ হলো।” “যেখানে ব্যবস্থা লঙ্ঘনও নাই; সেইজন্য পরিত্রাণ বিশ্বাস দ্বারা হয়, যেন অনুগ্রহ অনুসারে হয়” (রোমীয় ৪:১৬ পদ)। বিধান দেওয়ার ৪৩০ বছর আগেই ঈশ্বর তাঁর মহা অনুগ্রহে আব্রাহামের নিকট এইরূপ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। “আর বিশ্বাস হেতু ঈশ্বর পরজাতিদিগকে ধার্মিক গণনা করেন। শাস্ত্রে দেখা যায় অব্রাহামের কাছে আগেই সুসমাচার প্রচার করা হয়েছিল, যথা “তোমাতে সমস্ত জাতি আশীর্বাদ প্রাপ্ত হইবে।” কাজেই যারা বিশ্বাস ও নির্ভর করে, তারা বিশ্বাসী অব্রাহামের সঙ্গে আর্শীর্বাদপ্রাপ্ত হয় কিন্তু যারা ব্যবস্থার ক্রিয়াকলাপে নির্ভর করে, তারা সকলে অভিশাপের অধীন হয়। শাস্ত্রে লেখা আছে, “যে কেউ ব্যবস্থা গ্রন্থে লিখিত সমস্ত ব্যবস্থা পালন করিবার জন্য তাহাতে স্থির না থাকে, সে শাপগ্রস্ত . . . কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তি বিশ্বাস হেতু বাঁচিবে। . . . খ্রীষ্ট মূল্য দিয়া আমাদিগকে (খ্রীষ্টানদের) ব্যবস্থার পাপ হইতে মুক্ত করিয়াছেন . . . যেন অব্রাহামের প্রাপ্ত আশীর্বাদ খ্রীষ্ট যীশুতে পরজাতিগণের প্রতি বর্তে, আমরা যেন বিশ্বাস দ্বারা অঙ্গীকৃত আত্মাকে প্রাপ্ত হই” (গালাতীয় ৩:৮-১১; ১৭ ও ২২-২৭ পদ এবং ইব্রীয় ৪:৬ পদ যেখানে আবার লেখা আছে যে ব্যবস্থা দেওয়ার আগেই সুসমাচার প্রচারিত হয়েছিল)।

উপসংহারে পাঠকদের বিচার বিবেচনার জন্য দুটি সিদ্ধান্ত উপস্থিত করছি :

(১) কেউ যদি খ্রীষ্টেতে বিশ্বাসী হয় তাহলে সে ব্যবস্থা বা বিধানের বাইরে থাকে, 
“কেননা ধার্মিকতার নিমিত্ত প্রত্যেক বিশ্বাসীর পক্ষে ব্যবস্থার পরিণাম” (রোমীয় ১০:৪ পদ)

(২) কেউ যদি ব্যবস্থার অধীন থাকে তাহলে ব্যবস্থা দ্বারাই সে শাপগ্রস্ত হয় এবং সে হেতু ঈশ্বরের সাক্ষাতে সে ধার্মিক গণিত হতে পারে না (গালাতীয় ৩:১০ পদ)।

ব্যবস্থার উদ্দেশ্য মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করা; মানুষকে পরিত্রাণ দেওয়া নয়। আগের আলোচনায় এ কথাই দেখান হয়েছে যে, “বিশ্বাস আসিবার পূর্বে আমরা ব্যবস্থার অধীন রক্ষিত ছিলাম, যে বিশ্বাস পরে প্রকাশিত হইবে তাহার অপেক্ষায় রুদ্ধ ছিলাম। এই প্রকারে ব্যবস্থা আমাদিগকে খ্রীষ্টের কাছে আনিবার জন্য আমাদের পরিচালক দাস (চাকর) হইয়া উঠিল যেন আমরা বিশ্বাস হেতু ধার্মিক গণিত হই” (গালাতীয় ৩:২৩,২৪ পদ)। ব্যবস্থা বেষ্টনী বা দেওয়ালের মত মানুষকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ছিল এবং সেই বেষ্টনী থেকে বের হবার কেবল একটি মাত্র দ্বার ছিল। বাইরে যাবার দ্বারের খোঁজ করতে করতে পাপী হাতড়ে সেই দ্বারের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেল যীশুই সে দ্বার। যীশু স্বয়ং বলেছেন, “আমিই দ্বার” (যোহন ১০:৯ পদ)। এজন্য প্রত্যেক বিশ্বাসীর পক্ষে “খ্রীষ্টই ব্যবস্থার পরিমান” (রোমীয় ১০:৪ পদ)। ব্যবস্থা শুধু অভিযোগই করতে পারে কিন্তু দয়া প্রদর্শনে সে অসমর্থ। ব্যবস্থা মানুষকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায় কিন্তু তাকে মুক্ত করে দেবার কোনো উপায় করতে পারে না। মুক্তিদাতা ঈশ্বর তাঁর মহা অনুগ্রহে যীশুর অনুরোধে পাপীদের ক্ষমা করেন এবং ব্যবস্থার অভিশাপ থেকে তাদের মুক্ত করে দেন।  

Comments

Popular posts from this blog

উপবাস - বাইবেলের আলোকে উপবাস

প্রতিমা পূজা এমনকি মূর্তি সম্পর্কে বাইবেল কী বলে? What does the Bible says about idolatry or even image?

ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করেছেন?